মোহাম্মদ আব্দুল হক
আমি বাঙালি সংস্কৃতির নানান উৎসবের নানান ডাল পালায় রবীন্দ্রনাথকে এখনো দেখি তার অনেক কবিতা ও গানে। তবে আমি দেড়শত বছর পরে এসে কেবল অন্ধ প্রেমিকের মতো সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে আর গিলতে চাই না। আসলে এখন আর সবখানে রবীন্দ্র সাহিত্যের পুরোটা ততোটা তাজা হিসাবে ধরা দেয় না। তবে এখানে এক টুকরো রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দেখুন, হয়তো এই অংশটুকুর সাথে আপনিও পরিচিত। কথাগুলো হলো:-
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ
না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো একলা চলো
একলা চলো একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়
ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে
সবাই করে ভয়
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে
সবাই করে ভয়
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর
মনের কথা একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায়
ওরে ওরে ও অভাগা,
সবাই ফিরে যায়
যদি গহন পথে যাবার কালে
কেউ ফিরে না চায়
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণ তলে
একলা দলো রে॥”
এই কাব্যাংশটুকু বাংলা সাহিত্যের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান হিসেবে বিভিন্ন মঞ্চে উপস্থাপিত হয়। কখনও চমৎকার নৃত্যের সাথেও মঞ্চে নিয়ে আসেন শিল্পী অত্যন্ত আকর্ষণীয় দেহ ভঙ্গিমায়। আমার ভালো লাগে। গান শুনতেও ভালো লাগে, আর গানের সাথে সাথে চিকন দেহ নিয়ে যদি কোনো শিল্পী গানের বিকাশ ঘটাতে পারেন; তখন আরো বেশি ভালো লাগে।
এ এমন এক গান, যার গভীর ভাবার্থ বুঝতে পারলে নিজেকে এক অনন্য অবস্থানে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে মানুষ জাতির পক্ষে এমন আহবানের সফল বাস্তবায়ন আকাশকুসুম কল্পনা এবং তা মানুষের চরিত্রের সাথে যায় না। সেটি আমি নতুন করে বলার কিছু নাই। প্রথম মানুষ আদম ও হাওয়া একলা পথ চলতে চলতে খুঁজে পেয়েছেন সঙ্গী ও সঙ্গীনি।
দেখুন উন্নত মস্তিষ্ক সমৃদ্ধ প্রাণী হয়েও মানুষ হিসেবে একা চলার পক্ষে বিশেষ কোনো মানবিক গুণের সন্ধান আমি পাই না। তাই এভাবে আকুল হয়ে সময়ের সন্তানকে একলা চলতে উৎসাহিত করতেও চাই না। আমার প্রথম সর্বোচ্চ সৎ চেষ্টা থাকে একলা চলা নয়; বরং মানুষ সাথে নিয়ে চলা। তাই আমি যুগের সকল সন্তানদের উদ্দেশ্যে বলি:-
“একটি কথা শুনরে বেটা
গভীর মনে শুন ,
মাকে ভালো বাসরে বেটা
মানুষ ভালো বাস।
ভাই বোন চিনরে বেটা
বাপের কূল চিন ,
কষ্ট করে জানরে বেটা
গাছের ফুল জান।
দাদা দাদি নানিরে বেটা
মায়ের মা-যে নানি ,
খালা ফুফু পাবিরে বেটা
নানার মায়া পাবি।
ধর্ম পথে থাকিসরে বেটা
ন্যায়ের পথে থাকিস ,
বুকে বল রাখিসরে বেটা
মানুষ সাথে রাখিস।
শক্ত হাতে ধরিসরে বেটা
বাপের বৈঠা ধরিস ,
জুড় পায়ে চলিসরে বেটা
মাটির পরে চলিস।
ডিম কলা খাবিরে বেটা
সবজি ভাত খাবি ,
খালে বিলে যাবিরে বেটা
পুকুর পাড়ে যাবি।
তাজা মাছ ধরবিরে বেটা
পুকুর থেকে ধরবি ,
মিলে মিশে রাঁধবিরে বেটা
সরষে বাটা রাঁধবি।”
মানুষ উন্নত প্রাণী বলেই একই পরিবারে বসবাস করেও তাদের মাঝে ভাবনার স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। এমনটি পশু, পাখি, পোকা বা সরীসৃপ জাতের প্রাণীতে দেখা যায় না। কাজেই সকল সময় আমার বা আপনার কিংবা যে কারো মতের সাথে সকল মানুষ মিলে হ্যাঁ হ্যাঁ বলবে, এমনটি আমরা আশা করতে পারি না। তবে মনে রাখা চাই, সর্বোত্তম মত কখন-ও একলা চলে না। সে মানুষ সাথে নিয়ে-ই চলে।
প্রিয় পাঠক, জন্ম মাত্রই মানুষ সামাজিক প্রাণী। কাজেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রেখে চলার ক্ষেত্রে আকুল আহবান কোনো ভাবেই সমর্থযোগ্য মনে করি না। গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় আমরা মানুষরা কোনো দূর্যোগে কিছুতেই সমাজ থেকে দূরে নই। আমার কথার ভাবার্থ খুঁজে পেলে ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। হুটহাট কোনো ভাবনায় ভুল বুঝতে পারেন। যুগের সকল মানুষের প্রতি শুভেচ্ছা রইলো।।
মোহাম্মদ আব্দুল হক: কলামিস্ট, কবি ও প্রাবন্ধিক।