রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে:
আমরা সবাই পার করছি একটু ভিন্ন ধরণের সময়। আমাদের সবার মাঝে কমবেশি বিষণ্ণতা, মনক্ষুণ্নতা এবং ভয় কাজ করা সত্ত্বেও আমরা ফ্যামিলি এবং সুইডিশ ফিকার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি আমদের সময়।
আমি সুইডেনে একা একা অনেক সময় থেকেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন। বিশেষ করে ক্রিস্টমাস, ইস্টার হলিডের সময়। ক্রিস্টমাসে সুইডিশরা বাড়িতে তাদের নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে সময় দেয়। আর তখন আমার জীবনের শুরুতে করিডোরে একা একা সপ্তাহ খানেক কাটিয়েছি।
তবে শহরে যেতাম দিনের বেলায় একা একা ঘোরাঘুরি করে কিছুটা নির্জনতা কাটাতে। রাতে বড্ড একাকী মনে হতো। আস্তে আস্তে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ হয়, যার কারণে একা একা থাকার অভ্যাস কেটে গেছে বহু বছর আগ থেকে। তিন যুগ পর দেখছি এখন অনেকের জীবনে একা একা চলাফেরা থেকে শুরু করে বসবাস করতে হচ্ছে একাকী! সুইডিশ জাতি একা একা বসবাস করায় অভ্যস্ত। তবে তা হয়ে থাকে তাদের নিজ নিজ শর্তে।
নোবেল করোনা ভাইরাসের কারণে অনেকের জীবনে এসেছে নির্জনতা। সবসময়ই একা আবার কখনও একা নয়। সে আবার কেমন কথা? হ্যাঁ, নিজ নিজ দায়িত্বে নিজেকে সবার থেকে দূরে রাখা আবার বাইরে একা একা চলাফেরা করা, দূর হতে শুধু হাই এন্ড বাই বলা ইত্যাদি হয়েছে জীবন পার করার নতুন একটি ভিন্নধর্মী সময়। সুইডিশরা সময় পেলেই ভ্রমণ করতে, সমুদ্রসৈকতে সময় কাটাতে, রাতে বাইরে যেতে পছন্দ করে। কিন্তু এখন পছন্দ নয়, বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে যা কিছুটা আইসোলেশন বলা যেতে পারে।
দুঃসময় যাচ্ছে সবারই। জীবনে যখন দুঃসময় আসে তখন সবকিছুই যেন কঠিন এবং দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে এই কঠিন সময়ে ইতিবাচক থাকা চাই। দুঃসময়ে ইতিবাচক থাকতে যে পরামর্শগুলো আমি দিব আশা করি সবার কাজে লাগবে। হাজার প্রকার ব্যক্তিত্বকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুটি সাধারণ মাপকাঠিতে ভাগ করা যেতে পারে। ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটলে আমরা প্রতিদিনই নিজেকে উজ্জীবিত করতে পারি, অন্যকে অনুপ্রাণিত করতে পারি।
আবার নেতিবাচক ব্যক্তিত্বকে প্রয়োজন এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ইতিবাচক হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। দুঃসময়ে আমাদের পাশে ইতিবাচক মানুষ থাকা প্রয়োজন। ইতিবাচক মানুষের সংস্পর্শে থাকলে তারা আমাদের কঠিন সময় পাড়ি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সাহায্য করে।
নেতিবাচক বিষয় নিয়ে যখন আমরা ভেঙে পড়ি তখনই যে মানুষগুলো আমাদের পাশে ইতিবাচক আশা নিয়ে দাঁড়াবে তাদেরকে এখন দরকার। দুঃসময়ে নেতিবাচক মানুষকে এড়িয়ে চলা ভালো। কারণ তারা জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে এবং মনের স্পৃহা নষ্ট করে দেয়।
নিজেকে অর্থহীন করে তোলে এই নেতিবাচক মানুষেরা। অন্যদিকে ইতিবাচক মানুষের সংস্পর্শে থাকলে দেখা যাবে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর দিকেই বেশি নজর পড়ছে। নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা দেখতে পারা যাবে।
যা নেই তা নিয়ে সময় নষ্ট না করে বরং যা আছে তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। এ সময় নিজের যা আছে তা আনন্দচিত্তে উপভোগ করতে হবে। মনে রাখা দরকার যা নেই তা নিয়ে বিলাপ করা সহজ। যা নেই তা নিয়ে ভাবার চেয়ে যা আছে তা নিয়েই বেশি ভাবা উচিত। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা কঠিন সময় যখন পার করি তখন অনেক ক্ষেত্রে দরকার সুস্থ থাকা, চাকরিতে বহাল থাকা এবং যারা দুঃখে আনন্দে পাশে থাকে এমন প্রিয় মানুষ বা বিষয়কে মূল্যায়ন করতে হবে।
এই বিষয়গুলোকে আশীর্বাদ বলে মনে করতে হবে। এখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ভালো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। যে বিষয়গুলোর জন্য ভালো সময় কেটেছে জীবনে তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা জরুরি।
অলসতা ছেড়ে ঘরের কাজে মন দেয়া যেতে পারে। একেবারে শুয়ে বসে অলস সময় কাটানোর চেয়ে ঘরের কাজে সময় দেয়া যেতে পারে। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি, গল্পগুজব, ব্যয়াম করা যেতে পারে। সময় সুযোগ পেলে একটু-আধটু মেডিটেশন করা যেতে পারে।
সন্তান, স্ত্রী, পরিবার সবাই মিলে সময় কাটানো সত্যি এখন একটি চমৎকার সময়। জীবনে কঠিন সময় যখন যাচ্ছে তখন একটু মেডিটেশন বা ধ্যান করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। দূর থেকে অন্যদের দেখার একটি ভালো সময় এখন। নিজের দুঃসময়ের চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। সে ক্ষেত্রে অন্যদের সাহায্য করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো যেতে পারে। মন ভালো করা ও আত্মউদ্যম বাড়ানোর সবচেয়ে ভালো পন্থা হচ্ছে নিজের ওপর থেকে ফোকাস সরিয়ে অন্যকে নিয়ে ভাবা।
নেতিবাচক ভাষা ব্যবহার এবং নেতিবাচক বার্তা বিনিময়েও সতর্ক থাকার জন্য কী করা যেতে পারে? মন-মেজাজ ঠিক না থাকলে কারও ওপর চটে খারাপ ভাষা ব্যবহার না করা বা ব্যক্তিগত জীবনে নিজের ভাষা প্রয়োগের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।
নিজের আদর্শের জানার একটি সুন্দর সময় এখন। নিজেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় কখন দেখা হয়েছে? সে অবস্থার চিত্রটি মনে করে নিজেকে সেই আদর্শের জায়গায় এনে দেখা যেতে পারে।
যেমন কী কী করতে মন চায় এবং সেইভাবে করতে পারলে কেমন হবে তা ঠিক করে নেয়া এবং কাজগুলো মনে মনে শুরু করা যেতে পারে। দেখা যাবে যে দুঃসময়কে পেছনে ফেলে তরতর করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নিজেকে সৃজনশীল করে দেখার একটি সময় এখন। ছবি আঁকা, কবিতা লিখতে চেষ্টা করা কিংবা কোনো সৃজনশীল কাজ করা যেতে পারে এসময়। প্রতিভা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কিন্তু চর্চা করা হয়নি। দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে সৃজনশীল কাজ করা সত্যি একটি ভালো উদ্যোগ।
এতে যেমন মন ভালো হবে তেমন ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা হবে। ব্যর্থতার ভয় দূর করার একটি চমৎকার সময় এখন। মেঘের আড়ালে সূর্যটাকে কল্পনার মাঝে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। মনের বাঘে নিজেকে যেন শেষ করে না দেয়া হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বর্তমান ব্যর্থতার সময়কে জয় করার একটি পরিকল্পনা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ব্যর্থ হওয়ার ভয় পেলে সামনে এগোনো সম্ভব হবে না। জীবনে ব্যর্থতা ছাড়া সামনে এগোনো যায় না। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কেন ব্যর্থতা আসছে তা খুঁজে দেখার সময় এখন এবং মনে মনে সামনে এগিয়ে যাবার মতো সফলতার বীজ বপন করতে হবে।
অতীতের বেদনা কিংবা ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা মাথায় না ঢুকিয়ে শুধু বর্তমান নিয়ে ভাবা যেতে পারে। বর্তমান জীবনের দিকে কি ইতিবাচকভাবে তাকানো সম্ভব? অন্যদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ বা দুঃখ কি ভাগাভাগি করা সম্ভব? যদি জীবন-স্পৃহা ঠিক না থাকে ইতিবাচক হওয়া কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে লক ডাউনের সময় নিজেকে নিয়ে রিসার্স করা যেতে পারে।
প্রতিদিন অন্তত পনেরো মিনিট কোথাও একটু নির্বিঘ্নে নিরিবিলি বসা এবং সবকিছু ছেড়ে মন শিথিল করে চোখ মেলে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করা, নিজেকে নিয়ে ভাবা, নিজেকে রিচার্জ করা যেতে পারে।
ভাবা যেতে পারে জন্মের শুরুতে কী হতে চেয়েছিলাম আর কী হয়েছি? কী স্বপ্ন দেখতাম জীবন নিয়ে আর শেষ পরিণতি কেমন হয়েছে বা হবে? কী মানবতা এবং মনুষ্যত্বে জীবনকে তৈরি করতে চেয়েছিলাম আর কী অবস্থায় উপনীত হয়েছি?