ইমন চৌধুরী
সুনীল ঠাকুর ছিলেন আমাদের পৈথারা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ফেনী শহর থেকে খানিকটা দূরে সীমান্তঘেঁষা এক গ্রাম পৈথারা। শহরে বড় হলেও বছর দুয়েক গ্রামের স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার।
বড় ভাইরা একদিন রীতিমতো কান ধরে টানতে টানতে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। সুনীল ঠাকুর ছিলেন তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্যার বেঁটেখাটো মানুষ। বেশ দূর থেকে রোজ হেঁটে আসতেন।
ঝড়, বৃষ্টি, রোদ- কোনো বাধাই মানতেন না। রোজ এসে হাজির হতেন স্কুলে। সুনীল স্যারের হাঁটার গতি ছিল প্রায় রকেটের কাছাকাছি। সবসময় সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরতেন।
পায়ে আটপৌরে স্যান্ডেল। সে সময় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যে বেতন পেতেন তাতে দামি জুতা পরার কথা ভাবতে পারতেন না অনেকে।
আমরা সকালবেলা স্কুলে গিয়ে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে। কখন স্যার আসবেন এই আশায়। একসময় সাদা বিন্দুর মতো দেখা যেত সুনীল স্যারকে।
গ্রামের মেঠোপথ ধরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছেন। চোখের নিমিষে স্কুলে হাজির হয়ে যেতেন স্যার। এত দ্রুত গতিতে আজ পর্যন্ত কাউকে হাঁটতে দেখিনি। সুনীল স্যার আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন।
এক অদ্ভুত কায়দায় স্যার হাজিরা ডাকতেন রোজ। খাতা খুলেই শুরু করতেন,‘এক, দুই, তিন, চার, সাত, আট, এগারো, সতেরো, একুশ, তেইশ, সাতাশ, আটত্রিশ…।’
মাঝখানে রোজ কতজন যে বাদ পড়ে যেতাম তার হিসাব ছিল না। আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম ‘প্রেজেন্ট স্যার’ বলার জন্য। কিন্তু কালে ভদ্রে ডাক পড়ত আমাদের একেকজনের।
এক মিনিটেরও কম সময়ে হাজিরা ডাকার কম্মো সেরে নিতেন স্যার। যেদিন ভাগ্য খুব ভালো থাকত সেদিন হয়তো ডাক পড়ত। কিন্তু পড়লে কী হবে? আমাদের ‘প্রেজেন্ট স্যার’ শোনার মতো ধৈর্য ছিল না স্যারের।
আমরা ‘প্রেজেন্ট স্যার’ বলতে বলতেই দেখা যেত দশ-বিশজন পেরিয়ে গেছেন স্যার। অগত্যা মুখ ব্যাজার করে বসে পড়তাম। সবমিলিয়ে স্কুলে উপস্থিতি নিয়ে খুব টেনশনে থাকতাম আমরা।
কিন্তু একসময় আবিষ্কার করলাম আমাদের ক্লাসে উপস্থিতি সবসময় শতভাগ। মানে রোল কল বাদ পড়লেও সবাইকে উপস্থিত দেখাতেন স্যার।
ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্যারের এই সীমাহীন মমতা নিয়ে আরও অনেক গল্প আছে আমাদের। কখনও কোনো শিক্ষার্থীর গায়ে তিনি বেত উঠিয়েছেন এমন ঘটনাও রীতিমতো বিরল। অথচ তখন স্কুলে বেত আনা এবং পড়া না পারলে ছাত্রছাত্রীদের কষে ধোলাই দেয়া ছিল আইনসিদ্ধ।
অথচ সামনে পড়লেই আদর করে উল্টো আমাদের পিঠ চাপড়ে দিতেন সুনীল স্যার।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর দুই ছাত্রের মাথার চুল কেটে দিয়েছেন ওই স্কুলের শিক্ষক বিপুল সরকার। চুল লম্বা রাখার অভিযোগে নবম শ্রেণীর ওই দুই ছাত্রকে প্রথম বেত দিয়ে পেটান বিপুল সরকার। পরে দুই ছাত্রের চুল কাটেন উপস্থিত শত শত শিক্ষার্থীর সামনে।
শিক্ষকের কাজ ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো। তাদের মানবিক বোধসম্পন্ন ও দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। চুল কাটার জন্য সেলুন আছে, নাপিত আছে।
যার যা কাজ তাকে তাই করতে দেয়া উচিত। বিপুল সরকার তার পরিচয় ও দায়িত্বের কথা ভুলে গেছেন হয়তো। কোনো ছাত্রের চুল কাটা তার দায়িত্ব না। দয়া করে শিক্ষকরা শিক্ষাদান করুন।
চুল কাটতে দিন নাপিতদের। বিপুল সরকার যে কাণ্ড করেছেন তাতে দেশের নাপিতরা বেকার হয়ে পড়তে পারে। এমনিতেই দেশে বেকারের সংখ্যা অনেক। দয়া করে এ সংখ্যাটা আর বাড়াবেন না।