রোগীর ক্ষেত্রেও এ বার হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করা হলো নরেন্দ্র মোদির ভারতে। গুজরাটের আমদাবাদে করোনা আক্রান্তদের জন্য সরকারি হাসপাতালে যে ওয়ার্ড তৈরি হয়েছে সেখানে হিন্দুদের রাখার জন্য একটা ওয়ার্ড এবং মুসলিম রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে। যা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদি এই গুজরাটের মুক্যমন্ত্রী ছিলেন।
হাসপাতালের দাবি, সরকারের নির্দেশেই এ কাজ করা হয়েছে। যদিও সরকারের বয়ান, এ বিষয়ে তাদের কিছুই জানা নেই। তবে রোগীরা জানিয়েছেন, রোববার সন্ধ্যায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে হিন্দু এবং মুসলিমদের পৃথক করে দেয়া হয়েছে। হিন্দুদের ওয়ার্ডে ঠাঁই পাবেন না মুসলিম রোগীরা এবং মুসলিমদের ওয়ার্ডে রাখা হবে না হিন্দুদের। ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বাধীন ভারতের সাত দশকের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। এটি শুধু অমানবিক ঘটনা নয়, অসাংবিধানিকও। কারণ, সংবিধান অনুসারে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয়দের এই ভাবে আলাদা করে দেখা যায় না।
আমদাবাদের সিভিল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১২০০ টি বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সেখানে ভর্তি ১৫০ জন। আরও ৩৬ জনের করোনা পরীক্ষা হয়েছে। তাঁরা একটি পৃথক ওয়ার্ডে আছেন। হাসপাতাল সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, এর মধ্যে অন্তত ৪০ জন মুসলিম রোগী। গত সপ্তাহেই যাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তেমনই এক করোনা আক্রান্ত মুসলিম রোগীর পরিবারের সদস্য ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, রোববার সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, হিন্দু এবং মুসলিম রোগীদের পৃথক ওয়ার্ডে রাখা হবে। সেই মতো রাতেই মুসলিম রোগীদের অন্য ওয়ার্ডে সরিয়ে দেয়া হয়।
হাসপাতালের সুপার গুণবন্ত রাঠোর জানিয়েছেন, রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা মেনেই এ কাজ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। যদিও গুজরাটের উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিতিন প্যাটেল জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই।
তবে রোগীদের বক্তব্য, রোববার সন্ধ্যায় আচমকাই আইসোলেশন ওয়ার্ডে ঢুকে প্রাথমিক ভাবে ২৮ জনের নাম ঘোষণা করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রত্যেকেই মুসলিম। তাঁদের বলা হয়, অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। এ বিষয়ে সিভিল হাসপাতালের এক স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ডয়চে ভেলে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ব্যক্তির মন্তব্য, ‘হিন্দু এবং মুসলিমদের সুবিধার্থেই এ কাজ করা হয়েছে।’ তার আরও বক্তব্য, দিল্লিতে তাবলিগ-ই-জামাতের সমাবেশ থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়ার ফলে হিন্দুদের মধ্যে ‘ভয়’ তৈরি হয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই আইসোলেশন ওয়ার্ডেও দু’টি সম্প্রদায়কে আলাদা রাখা হয়েছে, যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।
কার নির্দেশে সরকারি হাসপাতালে এমন ঘটনা ঘটল, তা স্পষ্ট না হলেও বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘মানবতার কথা তো অনেক পরের বিষয়। গুজরাটে যা ঘটেছে তা অসাংবিধানাকি। ভারতের সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা আছে। সংবিধানের প্রস্তাবনাতেও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি আছে। জাত, ধর্ম দেখে রোগী চিহ্নিত করা এবং পৃথক করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা হতে পারে না।’
তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন চিকিৎসক সাত্যকি হালদার। এক সময় পশ্চিমবঙ্গের একটি সরকারি হাসপাতালে সুপারের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। সাত্যকির বক্তব্য, ‘রোগীর কোনও ধর্ম হয় না। এমবিবিএস পাশ করলেই ডাক্তারদের শপথ নিতে হয়। গোটা বিশ্বেই এ নিয়ম আছে। সেখানে বলতে হয়, রোগী দেখার সময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষার ক্ষেত্রে কোনও পক্ষপাতমূলক অথবা বিভেদমূলক আচরণ করা হবে না। চিকিৎসকের কাছে সকলেই সমান। গুজরাটের এই ঘটনা চিকিৎসার নৈতিকতাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসলো। এটা অনভিপ্রেত।’
গত কয়েক বছরে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ এবং উস্কানি চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। কয়েক মাস আগেই দিল্লিতে ঘটে গিয়েছে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মৃত্যু হয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি সাধারণ মানুষের। এখনও গৃহহীন অসংখ্য। তারও আগে এনআরসি, সিএএ নিয়ে অশান্তি চলেছে মাসের পর মাস। রাস্তায় নেমেছেন মুসলিম মহিলারা। গোটা দেশ জুড়ে তারা দিনের পর দিন অবস্থান বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। রাস্তায় নেমেছেন ছাত্ররাও। সেখানেও হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরির চেষ্টা হয়েছে। তারই মধ্যে শুরু হয় করোনার প্রকোপ। ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা হয়। লকডাউনের কিছু দিন আগে দিল্লিতে ধর্মীয় সমাবেশ করে তাবলিগেরপ্রচারকরা। সেই সমাবেশ থেকে করোনা ছড়িয়েছে বলে বিবৃতি দেয় সরকার। যদিও সেই একই সময়ে ঘটে যাওয়া আরও বহু ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সমাবেশের কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির আইটি সেল একের পর এক ‘ভুয়ো খবর’ প্রচার করতে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেশের মূলস্রোতের বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমও সেই খবর প্রচার করে। যেখানে দেখানো হয় তাবলিগের প্রচারকরা রেস্তোঁরার খাবারে থুতু ফেলছেন, পুলিশের গায়ে থুতু দিচ্ছেন করোনা ছড়ানোর জন্য। পরে জানা যায়, ওই সমস্ত ছবিই ভুয়ো। এখনও পর্যন্ত ওই সমস্ত ছবি এবং খবরের প্রচারকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু জনমনে বিভেদের বিষ ঢুকে গিয়েছে। গুজরাটের এই ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাম নেতা এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘দেশের শাসক দল এটাই করতে চাইছিল অনেক দিন ধরে। সংবিধানের তোয়াক্কা করে না তারা। এতদিন ভিতরে ভিতরে বিভেদের রাজনীতি চলছিল। সিএএ করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল এ বার বিভেদের রাজনীতি প্রকাশ্যে হবে। গুজরাটের ঘটনা তা আরও স্পষ্ট করে দিল। তবে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। বিভেদের রাজনীতি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তো শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য হাসপাতাল তৈরির কথা বলেছেন। সবই সমান। এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য চরম সংকটে।’
বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু অবশ্য এর মধ্যে রাজনীতি দেখতে পাচ্ছেন না। তার বক্তব্য, ‘চিকিৎসকরা যদি মনে করেন হিন্দু-মুসলিমকে আলাদা রাখলে চিকিৎসায় সুবিধা হবে, তা হলে আমার কিছু বলার নেই। চিকিৎসকদের পরামর্শে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ যদিও দেশের ডাক্তারদের বক্তব্য, কোনও চিকিৎসকের পক্ষে এমন পরামর্শ দেয়া সম্ভব নয়। কারণ রোগ এবং চিকিৎসার সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। যারা বিষয়টিকে চিকিৎসকদের পরামর্শ বলে চালানোর চেষ্টা করছেন, তারা হয় মিথ্যা বলছেন, অথবা সত্য থেকে চোখ ঘোরানোর প্রচেষ্টায় আছেন।
গুজরাটের সিভিল হাসপাতালের ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেরই ধারণা, এর ফলে রাতারাতি হাসপাতাল নিয়ম পরিবর্তনও করতে পারে। সে কারণেই কেউ এর দায় নিতে চাইছেন না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা। সূত্র: ডয়চে ভেলে