মোঃ শামছুল আলম
‘লাইলাতুল কদর’ আরবি শব্দ। শবে কদর হলো ‘লাইলাতুল কদর’-এর ফারসি পরিভাষা। ‘শব’ অর্থ রাত আর আরবি ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থও রাত বা রজনী। কদর অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত রজনী বা মহিমান্বিত রজনী।
এ রাতেই সুরা কদরের মাধ্যমে ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়েছে। এই রাতকে মহান আল্লাহ তা`আলা নিজেই হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। এ রাতকে যে কাজে লাগাতে পারেনি আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.) তাকে বড় হতভাগা বলেছেন।
মোমিনগণ চাইলে এ রাতকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেন। এ রাতের প্রত্যেকটি আমল আল্লাহর দরবারে গৃহিত হয়। কেবল কয়েক শ্রেণির মানুষ ছাড়া বাকী সবার দোয়া কবুল হয়। মাত্র একরাতের আমল দিয়ে নিজেকে জান্নাতি বানানোর সুযোগ করে দিয়েছে শবে কদর।
মহিমান্বিত এ রাত সর্ম্পকে হাদিস শরীফে অসংখ্য ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি কোরআন শরীফে সুরা কদর নামে স্বতন্ত্র একটি পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। এই সুরাতেই শবে কদরের রাত্রিকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী নবী এবং তাদের উম্মতগণ দীর্ঘায়ু লাভ করার কারণে বহু বছর আল্লাহর ইবাদাত করার সুযোগ পেতেন। সাহাবায় কেরামগণের এ আক্ষেপের প্রেক্ষিতে চিন্তা দূর করার জন্য সুরাটি নাজিল হয়।
কোরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে শবে কদর রমজান মাসে আসে; কিন্তু এর সঠিক কোনো তারিখ নির্দিষ্ট নেই। বুখারি ও মুসলিম বর্ণিত হাদিসের আলোকে বলা যায়, শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলো শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অধিকাংশ হাদিসের রেওয়ায়েত অনুসারে ওলামায়ে কেরামগণ বলেছেন যে উহা শেষ দশকেই রয়েছে। নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, তোমরা শবে কদরকে তালাশ করবে রমজানের শেষ দশকে, মাসের নয় দিন বাকি থাকতে, সাত দিন বাকি থাকতে, পাঁচ দিন বাকি থাকতে (বুখারী)।
অপর হাদিসে আবু বাকর (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলে কারীম (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, তোমরা শবে কদরকে তালাশ করবে রমজানের নয় দিন বাকি থাকতে, সাত দিন বাকি থাকতে, পাঁচ দিন বাকি থাকতে, তিন দিন বাকি থাকতে অথবা শেষ রাত্রিতে- অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ রমজানের রাত্রিতে (তিরমিজী)। এই জন্য আমাদের উচিত রমজানের বাকি দিনগুলো, বিশেষ করে রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা এবং শবে কদরের তালাশ করা।
হাদিসের আলোকে আরও জানা যায়, রাসুল (সা.)-কে যখন এর তারিখ ভুলিয়ে দেওয়া হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, সম্ভবত এতে তোমাদের কল্যাণ নিহিত আছে। অর্থাৎ যদি এ রাত নির্দিষ্ট করে দেওয়া হতো তবে অনেক অলস প্রকৃতির মানুষ শুধু এ রাতে ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত হতো। অবশিষ্ট সারা বছর ইবাদত বন্দেগি না করে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চিত থাকত।
দ্বিতীয়ত, এ রাত নির্দিষ্ট করা হলে কোনো ব্যক্তি ঘটনাক্রমে রাতটিতে ইবাদত করতে না পারলে সে দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশ করতে করতে অনেক সময় নষ্ট করে দেবে। এতে সে মাহে রমজানের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। এ রাত যেহেতু নির্দিষ্ট করা হয়নি, সে জন্য এ রাতের সন্ধানে আল্লাহর সব বান্দা প্রতি রাতে ইবাদত বন্দেগি করে থাকে এবং প্রত্যেক রাতের জন্য পৃথক পৃথক পুণ্য অর্জন করতে থাকে।
আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন-
‘নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
কদরের রাত্রের অপার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অন্যত্র ঘোষণা করেছেন-
‘হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪)
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাযহারি)
এ রাতে ফিরিশতাগণ যমীনে অবতরণ করেন-
‘হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শবে ক্বদরে হযরত জিবরাঈল (আ.) ফিরিশতাদের সাথে দলবদ্ধ হয়ে অবতরণ করেন। তাঁরা ঐসব লোকদের জন্য রহমতের দু’আ করতে থাকেন, যারা রাত জেগে দাঁড়িয়ে বা বসে আল্লাহর জিকির ও ইবাদতে মশগুল থাকেন। তারপর রমজান গত হয়ে যখন ঈদুল ফিতর আসে, তখন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদের নিয়ে ফিরিশতাগণের সামনে গর্ববোধ করেন। (কেননা, তারা সৃষ্টির আদিলগ্নে বিরোধিতা করেছিল) তখন তিনি ফিরিশতাদের জিজ্ঞেস করেন, ঐ শ্রমিকের পারিশ্রমিক কি হতে পারে, যে পূর্ণ শ্রম ব্যয় করেছে। উত্তরে তারা বলে, তাদের প্রতিদান হলো পূর্ণ পারিশ্রমিক দিয়ে দেয়া। তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে ফিরিশতারা! আমার বান্দা ও বান্দীরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছে, অতঃপর আমার নিকট দু’আ করতে করতে ঈদগাহে বের হয়েছে। আমার সম্মান ও বড়ত্বের কসম! জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আমি তাদের দু’আ কবুল করব। তারপর (বান্দাদের উদ্দেশ্যে) বলেন, তোমরা ঘরে ফিরে যাও, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তারা বাড়ি ফিরে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে।’ [ মিশকাত-১৮২]
এ রাত হাজার মাস থেকে উত্তমঃ
তাফসীরবিদগণ উল্লেখ করেছেন, ক্বদরের এক রাতের ইবাদত ঐ হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম যাতে লাইলাতুল ক্বদর নেই। আর যেহেতু ১০০০ মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়, এই হিসেবে যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদর পেল এবং তাতে ইবাদত করলো, সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাস আল্লাহর ইবাদত করে কাটিয়ে দিল। এ কথাটিও লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তা’আলা লাইলাতুল ক্বদরকে হাজার মাস থেকে উত্তম বলেছেন; হাজার মাসের বরাবর নয়। এখানে উত্তম কতগুণ হবে? দুইগুণ; তিনগুণ; চারগুণ না শতগুণ? তা তিনিই ভাল জানেন।
এ রাতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত মঙ্গল, কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তার বৃষ্টি বর্ষিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন –
“সে রাত পুরোটাই শান্তি” [সূরা ক্বদর-৫]
তাফসীরবিদগণ এর অনেক উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন-
১. এ রাতের শুরুলগ্ন থেকেই ফিরিশতাগণ দলে দলে আকাশ থেকে যমীনে অবতরণ করতে থাকেন এবং জাগ্রত ও ইবাদতগুজার বান্দাদের সালাম করেন। ইহা হযরত শা’বী রহ. হতে বর্ণিত। ফিরিশতাগণের এ সালামকে সাধারণ ও তুচ্ছ মনে করা উচিত নয়। বরং এতে উম্মতে মুহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কেননা পূর্বেকার যামানায় ফিরিশতাগণ শুধুমাত্র নবীগণের নিকট আসতেন ওহী নিয়ে। আর এখন উম্মতে মুহাম্মদীর কাছে আসেন দুরূদ ও সালাম সহকারে।
২. এ রাত সকল বিপদাপদ ও অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ। ফিরিশতারা কল্যাণ ও বরকত নিয়ে যমীনে আগমন করেন। কোন প্রকার কষ্ট ও পীড়াদায়ক জিনিস নিয়ে নয়।
৩. এ রাত ধূলিঝড়, সাইমুম, বিজলী ও বিকট আওয়াজ থেকে মুক্ত থাকে। আবু মুসলিম রহ. এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
৪. এ রাত শয়তানের অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ। অর্থাৎ শয়তান এ রাতে কোন প্রকার খারাপ কাজ করতে পারে না। কাউকে কষ্টে ফেলতে সক্ষম হয় না। এ অভিমত বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ রহ. এর। [তাফসীরে কাবীর-৩২/৩৬]
তবে শবে কদরে চার শ্রেণির মানুষকে ক্ষমা করা হবে না, তাদের কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না যতক্ষণ না তারা এসব অপকর্ম থেকে সংশোধন হবে।
এই চার শ্রেণির মানুষ হলো, এক- মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি, দুই- মাতাপিতার অবাধ্য সন্তান, তিন- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, চার- হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ও সম্পর্কছিন্নকারী। (শুয়াবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড)।
মহিমান্বিত এই রজনীতে উচিত নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখা, ফরজ নামাজ আদায় করে তার সঙ্গে সুন্নত, নফল নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, না পারলে তেলাওয়াত শোনা, বেশি পরিমাণে রাসুল (সা.) এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করা, না ঘুমিয়ে রাতভর জিকির আসকার করা, দোয়া মোনাজাতে শামিল হওয়া, বেশি করে দান সদকা দেয়া, অনাহারির মুখে ভাল খাবার তুলে দেয়াসহ যত ভাল কাজ আছে সবকিছু করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
তাই আসুন! শবে কদরের এই ভাগ্য রজনিকে হেলায় নষ্ট না করি, তাহলে আমাদের মত বড় দুর্ভাগা আর কেউ থাকবে না।
আল্লাহ আমাদের শরীয়ত মোতাবেক শবে কদরে উত্তম আমল করার তওফিক দিন। আমীন।
মোঃ শামছুল আলমঃ লেখক, প্রাবন্ধিক।