নজরুল ও হাদীরা কখনো মরে না
ফায়সাল আইয়ূব
ঘরে ঘরে মনে হয় ‘বিষের বাঁশি’ বাজতে দেরি নাই আর। যে বাঁশি বাজাতে শুরু করেছিলেন আমাদের মানবসিংহ উসমান হাদী। আর জারজ কুলাঙ্গাররা ওই বাঁশিতেই ভয় পেয়ে গেলো। হাতে তুলে নিলো বন্দুক আর গুলি মেরে দিলো সিংহের মাথায়! তবে, সিংহদের যে মৃত্যুভয় নেই, সেটা ভুলে গিয়েছিলো জংলী সারমেয়রা।
ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ বিরোধী কোনো সত্যিকার বাংলাদেশপ্রেমিককে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এ কারণেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, ইলিয়াস আলী, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ইফতেখার হোসেন দিনার, আবরার হোসাইনসহ নবীন প্রবীণ আরো বহু নেতাকে। নিঃসন্দেহে উসমান হাদী সেই দল ও ধারাবাহিকতার অনিবার্য একজন; তার মাথায় গুলি করার মধ্য দিয়ে এটা আবারও দিবালোকের মতো স্পষ্ট প্রমাণ হয়ে গেলো।
একটি বিশ্লেষণ
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশ করেন। কবিতাটি ছিল বিপ্লবের স্ফূলিঙ্গবাহক, যেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুস্পষ্ট। কবিতাটি প্রকাশের পরই আধিপত্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার নজরুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে। এবং ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি প্রায় এক বছর কারাবন্দি ছিলেন। কারাবন্দি নজরুলের ওপর ব্রিটিশ শাসক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছিল, এবং এ বিষয়ে বেশ নির্ভরযোগ্য প্রমাণও রয়েছে। তেমনি, আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের মানবসিংহ উসমান হাদীও বজ্রপাতের মতো ফুসে উঠেছিলেন ফ্যাসিস্ট আর আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে। তার সেই জ্বালাময়ী কন্ঠরোধ করতেই থাকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত।
শারীরিক নির্যাতন
নজরুল নিজেই লিখেছিলেন তাঁর ওপর কাঠোর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা। তাকে দীর্ঘক্ষণ শিকলবন্দি রাখা, এবং খাবার–পানীয় কম দেওয়ার মতো আচরণ করা হতো। তাঁর অনশনের সময় ইংরেজরা তাঁকে জোর করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও, এর পুরো প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত অমানবিক—জোরপূর্বক টিউব ঢুকিয়ে খাওয়ানো ইত্যাদি।
মানসিক নির্যাতন
নজরুলকে দীর্ঘদিন একা রাখা, পাঠাগারে যেতে না দেওয়া এবং পত্রপত্রিকা বা বাইরের খবর থেকে বঞ্চিত রাখা—এসব ছিল স্পষ্ট মানসিক চাপ সৃষ্টি করার কৌশল। তাঁর লেখা, বিশেষ করে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’, থেকে জানা যায় যে তাঁকে বারবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হতো।
ইতিহাসবিদদের সাধারণ অভিমত
বিভিন্ন জীবনী ও গবেষণামূলক গ্রন্থ—যেমন মোহিতলাল মজুমদারের নজরুল জীবনী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য গবেষকের কাজ—এসবেই উল্লেখ আছে যে নজরুল ব্রিটিশ কারাগারে অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন।
এ ঘটনার আগে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে নজরুল সৃষ্টি করেন ‘বিদ্রোহী’। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশের পরপরই বিজলীসহ অন্যান্য পত্রিকায় কবিতাটির প্রতিক্রিয়া ও ব্যাখ্যা নিয়ে তিনি মন্তব্য/আলোচনা করেন, যা ১৯২২ সালেই ঘটেছে বলে নথিভুক্ত।
বিদ্রোহের দাবানল পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইংরেজ শাসক নজরুলকে নানামাত্রিক মানসিক শারীরিক নির্যাতন করলেও হত্যা করেনি; বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পরাজিত শক্তি, ফ্যাসিস্টদের প্রেতাত্মা, আমাদের এখনকার বিদ্রোহী, তারুণ্যের প্রোজ্জ্বল সূর্য ওসমান হাদীকে বাঁচতে দিতে চায় না! এ জন্যে তারা তার মাথায় গুলি করেছে। তারা বুঝতে পারে না, তারা অনুধাবন করতে পারে না যে, হাদী তো বহু আগে থেকেই বুক চিতিয়ে রাজপথে মরার জন্যে দেহমনে প্রস্তুত ছিল। তারা এও বুঝতে অপারগ যে, একজন হাদীকে বিদায় করলে দাবানল কোথায় কতোখানি ছড়িয়ে পড়বে।
কাজী নজরুল ছিয়াত্তরে মারা গেছেন। অথচ, গত ৫০ বছর ধরে আমাদের প্রত্যেকটি সংগ্রামে নিরন্তর ছড়িয়ে যাচ্ছেন বিপ্লবের বারুদ। এর ৫৫ বছর আগে রচনা করেছেন ‘বিদ্রোহী’ আর সেই অমর কাব্যও ১০৪ বছর ধরে প্রত্যেকটি আন্দোলনে ছড়াচ্ছে বিদ্রোহের ভিসুভিয়াস।
এই তো সেদিন উসমান হাদীও মানবসিংহের মতো রাজপথে গর্জে উঠে পড়েছেন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’। একাই কোটি হয়ে গর্জন করেছেন ফ্যাসিস্ট, আধিপত্যবাদী আর কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে। সেই গর্জন সইতে না-পেরে তাকে গুলি করা হয়েছে। তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসুন, মনেপ্রাণে চাই। আর যদি তিনি আল্লাহ কাছে ফিরে যান, তাহলে দাবানলে ছাই হবে ফ্যাসিস্ট গুপ্তচরদের পাপের সকল আস্তানা। কারণ, নজরুল ও হাদীরা কখনো মরে না। তাদের কবিতা ও কথা জ্যামিতিক হারে মানুষে মানুষে সঞ্চারিত হতে থাকে। কবিতা ও কথাকে কখনো গুলি করা যায় না। আর এখানেই কবি ও বাগ্মীর সার্থকতা। সত্যিকার স্বদেশপ্রেমিকেরা এভাবেই যুগে যুগে মরেও অমর হয়ে যান।
ডিসেম্বর ১২, ২০২৫।। লন্ডন।





