আহমেদ রেজা:
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে সর্বশেষ বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় ঢল নামে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। সেই সময় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশটি থেকে আরও অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সবমিলিয়ে ৩৪টি অস্থায়ী ক্যাম্পে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার চাপে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া এলাকা এখন বিপর্যস্ত।
এরমধ্যে রোহিঙ্গা ঢলের পেরিয়ে গেছে তিন বছর। সংকট সমাধানে দ্বিপাক্ষিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বহু চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ফলাফল একেবারেই শূন্য। একজন রোহিঙ্গাও ফেরেনি নিজ দেশে। কবে ফিরবে তাও অজানা। ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গারা এখন গলার কাঁটাই হয়ে রয়েছে।
কিন্তু তিন বছরেও কেন এই অন্ধকার? সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক মনে করেন, এই সংকট ভূ-রাজনীতির অংশ। তিনি বলেন, ভারত প্রথমদিকে যে অবস্থানে ছিল এখন ওই অবস্থানে নেই। তারা স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেছে। চায়নাও বুঝতে পেরেছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না হলে এই এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসবে না। তাই বাংলাদেশকে একটি হাইব্রিড পলিসি গ্রহণ করতে হবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের কারণে শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে গত বছর বাংলাদেশ-চীন শীর্ষ বৈঠকে সহযোগিতার আশ্বাস এলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। গত তিন বছরে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনাও হয়েছে। গঠিত হয়েছে ত্রিপক্ষীয় কমিটি। কিন্তু প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখেনি। একইভাবে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি প্রতিবেশী ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় আশ্বাস পেলেও ভারত এখন পর্যন্ত এ ইস্যুতে বাংলাদেশকে সরাসরি সমর্থন করেনি।
মূলত, মিয়ানমানের ওপর চীন এবং ভারতের প্রত্যক্ষ স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দু’দেশই মিয়ানমারের বিনিয়োগ করছে। তাদের সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। আবার ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত এবং নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও বলছেন, ভারত ও চীন এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির বড় নির্ধারক। বড় দুই শক্তির আন্তরিকতা ছাড়া সংকট সমাধান সম্ভব না বলেই মনে করেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থের চেয়ে চীনের জন্য মিয়ানমারকে সমর্থন করা বেশি অনুকূল। ভারতেরও কিছু কারণ আছে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানোর। মূলত কেউই আমাদের সাথে শত্রুতা করার জন্য এমনটা করছে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের চেয়ে উপস্থিত স্বার্থ তারা বেশি করে দেখছে।
শুরু থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ছাড়া প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে।
এই সংকট নিয়ে দেনদরবার করা জাতিসংঘ এখন বলছে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। আর পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে কোনো গা করছে না মিয়ানমার। পশ্চিমা কূটনীতিকদের মতে, তাদের নতুন চাপ মিয়ানমারকে আরও চীনের দিকে ঠেলে দেবে এবং এর ফল হবে উল্টো। অন্যদিকে স্বার্থের সমীকরণে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য রাশিয়াও বিরোধিতা করছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের।
এখণ প্রশ্ন হলো সমাধান কোন পথে? ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দফা প্রস্তাব করেছিলেন জাতিসংঘে। তার মধ্যে রাখাইন রাজ্যে “সেইফ জোন” করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা সেটিকেই এখন কার্যকরী মনে করছেন।
একদিকে করোনা সংকট অন্যদিকে নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন। তাই এ বছরও যে সমাধানের কোন পথ মিলছে না তা অনেকটাই নিশ্চিত। এখন গলার কাঁটা হিসেবে রয়ে যাওয়া এই রোহিঙ্গারা কবে ফিরবে বলতে পারছে না কেউই।