বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অবশেষে পদত্যাগের ঘোষণা




স্টাফ রিপোর্টার,
652
হজ নিয়ে মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব হারানো ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এমপি পদ রক্ষার জন্য আইনি লড়াই চালাবেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল নির্বাচন কমিশনে শুনানিতে হাজির হয়ে এ ঘোষণা দেন আলোচিত এ নেতা। এ সময় শুনানি মুলতবির আবেদন জানান টাঙ্গাইল-৪ আসনের এমপি লতিফ সিদ্দিকী। নির্বাচন কমিশন নিয়ম অনুযায়ী শুনানি মুলতবি করে। দুই সপ্তাহ পরে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ জানান। শুনানিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পক্ষে ছিলেন দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছার ও সাইফুদ্দিন খালেদ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও আইন শাখার যুগ্ম সচিবের উপস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের সম্মলন কক্ষে বেলা ১১টায় শুনানি শুরু হয়। লতিফ সিদ্দিকী পদত্যাগ করবেন জানিয়ে দিলে ১৪ মিনিটেই শুনানি শেষ হয়ে যায়। শুনানি শেষে লতিফ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবো। এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে গেলাম। এ নিয়ে আর শুনানি করার দরকার নেই। আমার ইমানে এতটুকু দুর্বলতা নাই। যা প্রচার হয়েছে, তা মিথ্যা প্রচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ইচ্ছার কথা উল্লেখ করে লতিফ বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, একটু বিলম্ব হয়েছে। আমি অবগত হয়েছি। আমার নেতা চান না আমি এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করি। আমি কমিশনকে বলেছি, আমি আর এ মামলা লড়তে চাই না। আমার সংসদ সদস্য পদ রক্ষার জন্য আর বৃথা লড়াই করবো না। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও নেতার প্রতি এখনও অনুগত বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, আমি যেহেতু অনুগত, আমি কমিশনকে বলেছি, আজকের এই শুনানি মুলতবি করা হোক। আমি মাননীয় স্পিকারের বরাবর আমার পদত্যাগপত্র পৌঁছে দেব। সংসদ সদস্য পদ নিয়ে লড়বার মতো দুর্বল মানসিকতা আমার নেই। এ সময় দেশের কল্যাণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করে গাড়িতে উঠে ইসি সচিবালয় ত্যাগ করেন তিনি। এর আগে ইসির শুনানি বন্ধের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু হাইকোর্ট তার ওই আবেদন নাকচ করে দেন এবং রোববার আপিলেও তা বহাল থাকে। সকালে আপিল বিভাগের আদেশ পাওয়ার পর আদালত থেকে সরাসরি নির্বাচন কমিশনে যান লতিফ সিদ্দিকী ও তার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
শুনানিতে যা বললেন লতিফ
মাত্র ১৪ মিনিটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও লতিফ সিদ্দিকীর শুনানি হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে নির্বাচন কমিশনে আসেন লতিফ সিদ্দিকী। এ সময় তার সঙ্গে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও সঙ্গে ছিলেন। ইসির যুগ্ম সচিব শুনানিতে নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে লতিফ সিদ্দিকীকে আমন্ত্রণ জানান। আসন থেকে লতিফ সিদ্দিকী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি কি এখানে কথা বলবো, নাকি পাশের ডায়াসে যাব? তখন এগিয়ে তার বাম পাশে রাখা শুনানিতে বক্তব্য রাখার নির্ধারিত ডায়াসে দাঁড়িয়ে লতিফ বলেন, আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি সাচ্চা মুসলমান, আমি জন আস্থায় বিশ্বাস করি। জনতার আদালতে আমি গিয়েছি। আমি সংসদ সদস্য। আইনগতভাবে ও সাংবিধানিকভাবে সংবিধানের ৬৬ (৪) অনুযায়ী আমার বিষয়ে স্পিকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় আমাকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, দল থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি। বহুভাবে বহুবার বহিষ্কার হয়েছি। এভাবে আর কখনও হয়নি। মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমি আনন্দের সঙ্গে, নির্লিপ্তভাবে ঘোষণা করছি- আমি টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবো। এটা আমার ঘোষণা, আমার সিদ্ধান্ত। এ সময় নির্বাচন কমিশনের শুনানির দরকার নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। আপনাদের আর কোন কার্যক্রম নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আপনাদের কষ্ট দিলাম। আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি, এখান থেকে মাত্র ৫ মিনিট পরেই তা কার্যকর হবে। স্পিকারের কাছে বিষয়টি জানানো হবে। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েমের প্রত্যাশা রাখেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছারকে শুনানিতে বক্তব্য দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডায়াসে দাঁড়িয়ে এ আইনজীবী বক্তব্য দেয়ার শুরুতেই বলেন, উনি (লতিফ) তো পদত্যাগের কথা বলছেন। এখন কি আমাকে আর কিছু বলতে হবে? এসময় নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ তার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করুন। উনি (লতিফ) তো পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তখন নিজের আসন থেকে দাঁড়িয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বলেছি। আমি সংসদে গিয়ে স্পিকারকে তা জানাব। এমন সময়ে আওয়ামী লীগের আইনজীবী তাদের শুনানির বক্তব্য শুরু করেন। কাওছার বলেন, নির্বাচনী আইন ও সংবিধান অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর আর সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকার সুযোগ নেই। তার সদস্য পদ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। এর পরেই লতিফ সিদ্দিকী ডায়াসে গিয়ে আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক। ইসি জানতে চায়, আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন কিনা? লতিফ বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এমপি পদ বাতিল চেয়েছে। আমার তো আর কিছু করার নাই, তাদের সঙ্গে একমত। তাই তো স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি। ১১টা ১২ মিনিটে প্রধান নির্বাচন কমিনার শুনানিতে অংশ নেয়া দুই পক্ষকে ইসির অবস্থান তুলে ধরেন। সিইসি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এখন কিভাবে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় তা সংবিধানে বলা রয়েছে। তিনি তা মেনেই কাজ করবেন আশা করি। শুনানি শেষে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিতর্ক নিষ্পত্তির বিধান থাকায় এ বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্তও পরে জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন সিইসি।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে মন্তব্যের কারণে বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর পাশাপাশি দল থেকেও বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। দেশে ফেরার পর ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মামলায় নয় মাস কারাগারে কাটাতে হয় টাঙ্গাইলের এই এমপিকে। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান তিনি। লতিফকে বহিষ্কারের আট মাস পর বিষয়টি জানিয়ে আওয়ামী লীগের পাঠানো চিঠি গত ৫ই জুলাই স্পিকার শিরীন শারমিনের হাতে পৌঁছায়। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ১৩ জুলাই দশম সংসদের টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি লতিফ সিদ্দিকীর আসন সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির প্রশ্নে ইসিতে চিঠি পাঠান। এ পরিপ্রেক্ষিতে মেম্বার অব পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৬ই জুলাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও লতিফ সিদ্দিকীকে লিখিত বক্তব্য দিতে বলে ইসি। ২রা আগস্ট তাদের জবাব কমিশনে পাঠানো হয়। এরপরই শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। আশরাফের চিঠিতে বলা হয়, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় লতিফ সিদ্দিকীর এমপি পদ না থাকাই সঙ্গত। অন্যদিকে লতিফ সিদ্দিকী তার এমপি পদ খারিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ইসিকে না নিয়ে তার ভার সংসদের উপর ছেড়ে দেয়ার আহ্‌বান জানান। কমিশনের চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন লতিফ। ওই চিঠি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে রুলও চান তিনি। এ বিষয়ে শুনানি করে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২০ই অগাস্ট আবেদনটি খারিজ করে দেয়। এরপর হাই কোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের নোটিশ স্থগিতের আবেদন করেন লতিফ। চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলে রোববার তা শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ‘নো অর্ডার’ দিলে হাই কোর্টের আদেশই বহাল থাকে। শেষ পর্যন্ত ইসির শুনানিতে অংশ নেন লতিফ সিদ্দিকী।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: