সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার শিবগঞ্জের গ্রামে একব্যক্তির তথাকথিত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং তার দাফন নিয়ে আতঙ্ক ও অচলাবস্থা নিরসনে এক যুবকের বলিষ্ঠ ভূমিকা চলমান করোনা প্রকোপকালে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই যুবকের নাম আমিনুল ইসলাম মুশফিক (৩০)। বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার নাটমরিচাই ভুরঘাটা গ্রামে।
গত শনিবার ২৮ মার্চ ভোরে শিবগঞ্জের দড়িদহ গ্রামের মাসুদ রানা নামে একব্যক্তি মারা যান। তার বয়স ৪৫ বছর। এই ব্যক্তির সর্দিকাশি জ্বর ছিল। প্রকৃত ঘটনা না জেনেই গ্রামের মধ্যে চরম আতঙ্ক। আর এই আতঙ্ক পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিপাকে পড়ে যায় উপজেলা প্রশাসন পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগ। এলাকার লোকজন কেউ মৃত ব্যক্তির বাড়ির সীমানায় যাচ্ছিল না। ডাক্তার ও প্রশাসন অনেকটা দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল।
তখন ওই এলাকার ত্রিশ বছরের এক যুবক আমিনুল ইসলাম মুশফিক মৃত ব্যক্তির বাড়ির ভেতরে যে ঘরে নিথর দেহ পড়ে আছে সেখানে গিয়ে রাতে কবর দেয়া পর্যন্ত তিনি যাবতীয় কাজ করে মানবতার স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন।
আমিনুল ইসলাম মুশফিক ২০১৩ সালে শিবগঞ্জ এমএইচ ডিগ্রী কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। এরপর কর্মসংস্থানে মাঠে নামেন। দু’বছর আগে বাড়ি ফেরার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তার বাম হাতসহ শরীরের ১২ স্থানে ফ্র্যাকচার হয়।
তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) পোস্ট দেন, করোনা সন্দেহের ও করোনা আক্রান্তের কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে কেউ সৎকার ও দাফন করতে না চাইলে তিনি হাত বাড়িয়ে দেবেন।
বিকেলে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রেজ্জাকুল ইসলাম রাজু ফেসবুকের সূত্র ধরে খবর দেন পূর্ব পরিচিত মুশফিককে। এরপর মুশফিককে নিয়ে যান ইউএনও আলমগীর কবীর ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানের কাছে। সেখানে মুশফিক সব শুনে মৃত ব্যক্তির সৎকার ও দাফন করতে আগ্রহী হন। জানতে চাওয়া হয় ভয়ভীতি আছে কি না। মুশফিকের জবাব, মায়ের আদেশ মৃত ব্যক্তি যদি পুরুষ হয় তাহলে সে যেন কবর দেয়া পর্যন্ত সব কাজ করে। আর নারী হলে যেন মাকে খবর দেয়া হয়। এরপর একজন চিকিৎসক ও একজন পুলিশ কনেস্টেবলকে সঙ্গে দিয়ে মুশফিককে পাঠানো হয় প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের দাড়িদহ গ্রামে। দেয়া হয় ব্যক্তি সুরক্ষা উপকরণ ও লাশ ভরানোর জন্য চেন লকযুক্ত প্লাস্টিকের বিশেষ কভার।
গ্রামে পৌঁছার পর ডাক্তার ও কনেস্টেবল দূরে দাঁড়িয়ে বাড়ি দেখিয়ে দেন। এরপর মুশফিক বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে মৃত ব্যক্তির ছোট মেয়ের কাছে জানতে চান মরদেহ কোন ঘরে। মুশফিক ভেতরে গিয়ে দেখেন-মশারির ভেতরে টিশার্ট ও প্যান্ট পরা মাসুদ রানার নিথর দেহ। মাসুুদ রানার স্ত্রী সাজেদা বেগমকে খবর দেয়া হয়। মুশফিকের একার পক্ষে এই লাশ নামানো কঠিন হলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে খবর দেয়া হয় আরও দু’তিনজন লোক আনতে। কেউ আসতে রাজি হয়নি। এর মধ্যে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাজু ও ময়দানহাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রূপম একজন গ্রাম পুলিশ একজন ভ্যান চালককে পাঠান। তাদের সঙ্গে তোফাজ্জল নামের এক তরুণ যোগ দেয়।
মুশফিক ও তোফাজ্জল গাউন মাস্ক গ্লাভস পরে মৃত ব্যক্তিকে খাট থেকে নামিয়ে ধর্মীয় বিধান মতে তায়াম্মুম করান। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী সাজেদা বাড়িতে থাকা কিছু সাদা কাপড় দেন। সেই কাপড়ে পেঁচিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে কবরস্থানে দাফন করার জন্য বের হলে গ্রামের লোকের প্রচ- বাধার মুখে পড়েন। তারা গ্রামের কবরস্থানে দাফনে বাধা দিতে এতটাই উগ্রতা দেখায় যে ইউএনও শেষ পর্যন্ত গ্রাম থেকে দূরে সরকারী খাসজমিতে দাফনের ব্যবস্থা করেন। থানার ওসি কবর খোঁড়ার জন্য লোক পাঠিয়ে দেন।
তারপর মুশফিক ভ্যান গাড়িতে লাশ তুলে বাকিদের নিয়ে রাতে রওনা দেন। প্রায় চার কিলোমিটার দূরে একটি প্রাথমিক স্কুলের কাছে গিয়ে জানতে পারেন তখনও কবর খোঁড়া হয়নি। কিছুক্ষণ পরে কবরের কাছে গিয়ে দেখেন কোন রকমে মাটি খোঁড়া হয়েছে। মুশফিক আরও কিছুটা খুঁড়ে প্লাস্টিকে ভরা লাশ কবরে রেখে বাঁশের টুকরো ওপরে দিয়ে মাটি চাপা দেন। কবর থেকে কিছুটা দূরে ইউএনও, থানার ওসি, ডাক্তার ও কয়েকজন দোয়া পাঠ করেন।
রাত প্রায় এগারোটার দিকে মুশফিক বাড়িতে ফেরার পর তার মা মাহফুজা বেগমের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন। মুশফিকের স্ত্রী শারমিন আক্তার হীরাকে বিষয়টি জানানো হয়নি। তবে পরে তিনি শুনেছেন। মৃত ব্যক্তির কবর দেয়ার পর ইউএনও, থানার ওসি মুশফিককে লকডাউনে থাকতে বলেন। সোমবার মৃত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে করোনা নেগেটিভ জানার পর মুশফিককে লকডাউন মুক্ত করা হয়। এর আগে ফেসবুকে মৃত ব্যক্তির দাফন নিয়ে গ্রামের লোকের বাধা ও পরে খাস জমিতে দাফনের বিষয়টি একজন পোস্ট করলে শিবগঞ্জ এলাকার ছেলে আমতলী মডেল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মীর লিয়াকত আলীর দৃষ্টিতে আসে। তিনি তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেন- এলাকার কেউ যদি এ ধরনের মৃত ব্যক্তির দাফনে কবরের জায়গা না দেয় তাহলে তিনি তার জায়গায় কবর দিতে দেবেন। বিষয়টি তিনি ওই রাতেই উপজেলা প্রশাসন ও থানার ওসি মিজানুর রহমানকে জানান।
এদিকে মুশফিকের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলমগীর কবীর, থানার ওসি মিজানুর রহমানসহ অনেকেই মুশফিকের মানবতা ও এই মহানুভবতাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এই বিষয়ে মুশফিকের সঙ্গে ফোনে কথা বললে জানান, এই সময়ে মানুষের কল্যাণে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন। এই তার ব্রত। এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, করোনা আক্রান্ত রোগী মারা গেলে তার সৎকারে ও দাফনে কোন বাধা নেই। কারণ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর জীবাণু নিষ্ক্রিয় হয়।