এম শাহজাহান ॥ করোনাভাইরাসের প্রকোপে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। করোনা সঙ্কট উত্তরণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছে সরকার। মূল লক্ষ্য, বর্তমান এই চরম দুর্যোগে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করে আগে মানুষের জীবন বাঁচানো। দ্বিতীয়ত অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। করোনা যুদ্ধে মানুষের জন্য সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান। রফতানি খাতের প্রণোদনা থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার ঘোষণা করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানা চালানো যাবে। এতে সরকারী কোন বিধি নিষেধ নেই।
বুধবার সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে তার নিজ দফতরে দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় শীর্ষক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন, তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকসহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতি রক্ষায় করোনা পরবর্তী করণীয় কি হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া বর্তমান অবস্থায় মাঠে সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কি কাজ করছে সে বিষয়ে কথা বলেন সেনা প্রধান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় করোনা যুদ্ধে মানুষের পাশে থেকে কাজ করছে সেনাবাহিনী। যতদিন করোনা যুদ্ধ রয়েছে ততদিন আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে কাজ করব।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত গার্মেন্টস খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার বিষয়টি সভায় স্পষ্ট করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, এটি কোন অনুদান নয়, পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ শতাংশ হারে ঋণ নিতে পারবেন। তবে ঋণের এই টাকা আগামী তিন মাস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় করতে হবে। অন্য কোন জায়গায় ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, কোন গার্মেন্টস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়নি। মালিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালাতে পারবেন।
এছাড়া করোনার বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সহযোগিতা চেয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, চরম এই সঙ্কটের মধ্যে করোনা নিয়ে গুজবসহ বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক খবর ছড়িয়ে পড়ছে। এই মূহূর্তে গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ মানুষকে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এছাড়া বাজারে দ্রব্যমূল্য সরবরাহ নিশ্চিতে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও করোনার আঘাতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রফতানি বাণিজ্যে ধস এবং রেমিটেন্স হ্রাস পাওয়ায় বড় ধাক্কা এখন অর্থনীতিতে। আগামী জুনে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবে সরকার। এই অবস্থায় সরকারের আয় কমার পাশাপাশি করোনার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ গতি হারাচ্ছে। বেকার হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাচ্ছে ঠিক তখন এই বিপর্যয় বাংলাদেশের জন্য বড় আঘাত। মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সচিবদের নিয়ে নিজ বাড়িতে করণীয় নির্ধারণে বৈঠক করেছেন। এর একদিন বাদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সচিবালয়ে সংশ্লিষ্ট সচিবসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে রফতানিমুখী গার্মেন্টস চালু রাখা যাবে ॥ বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যে কোন মালিক পোশাক কারখানা চালু রাখতে পারবেন। সরকারের পক্ষ থেকে কোন কারখানা বন্ধ করা হয়নি। তিনি বলেন, রফতানি খাতে ক্রেতাদের অর্ডার একটি বড় বিষয়। অর্ডারমতো পণ্য ডেলিভারি কিংবা শিপমেন্ট না হলে ক্রেতারা পণ্য নিতে চান না। এ কারণে রফতানিমুখী শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা চাইলে কারখানা চালু রাখতে পারবেন। সম্প্রতি বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা শ্রমিকদের বিষয়টি চিন্তা করে কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ ॥ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, গার্মেন্টস খাতকে দুই শতাংশ সুদে অনুদান নয় তাদের ঋণ দেয়া হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছেন। এ তহবিল থেকে ব্যবসায়ীরা কিভাবে সুবিধা পাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিল্পের জন্য ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে। একটা নির্ধারিত সময় পর এ অর্থ ফেরত দিতে হবে।
করোনা যুদ্ধে মানুষের পাশে থাকবে সেনাবাহিনী ॥ বৈঠকে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, করোনা যুদ্ধে সেনাবাহিনী সর্বদা মানুষের পাশে থাকবে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যত প্রয়োজন, তত সেনাসদস্য দেয়া হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা আরও বাড়ানো হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, যত প্রয়োজন, তত সেনাবাহিনী সদস্য দেয়া হবে। তবে অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টিরও প্রয়োজন নেই। এই যুদ্ধে মানুষের পাশে থাকবে সেনাবাহিনী। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ করোনাভাইরাসকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমরা সৈনিক, আমরা সবসময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। সবাইকে সহযোগিতা করব বলে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আছি। অহেতুক প্যানিক সৃষ্টি করার কোন প্রয়োজন নেই। জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার করোনার ব্যাপারে শুধু সেনাবাহিনী নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ সব স্টেকহোল্ডার কী করবে ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছেন।’
আমরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। আগামীতেও কাজ করব এবং এই করোনাভাইরাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন, আমরা সৈনিক আমরা সব সময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং সেই প্রস্তুতি নিয়ে আমার আছি সবাইকে সহযোগিতা করব। নোভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে ২৪ মার্চ থেকে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধায় সশস্ত্র বাহিনী দায়িত্ব পালন করে আসছে।
বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে ॥ বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। করোনা মোকাবেলায় শপিংমল মার্কেট ও বিপণিবিতান বন্ধ রাখা হলেও খোলা রয়েছে মুদিপণ্যের দোকান, সুপারশপ এবং কাঁচা বাজার। এছাড়া টিসিবি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় ভর্তুকি মূল্যে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছে। বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন বলেন, পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পণ্যবাহী ট্রাক চলা চল করতে পারছে। এছাড়া দ্রুত পণ্যখালাসে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ কারণে দু’একটি পণ্যের দাম বাড়লেও বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমে আসছে। সামনে শব-ই-বরাত ও রোজায় পণ্যের কোন সঙ্কট হবে না বলে জানান সচিব।
ঢাকায় ১০ টাকার চাল আসছে আগামী সপ্তায় ॥ ঢাকার গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় আগামী সপ্তায় ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রি করা হবে। এতে করে শহরের স্বল্প আয়ের মানুষ বিশেষ করে রিক্সাচালক, সিএনজি চালক, অটোচালক, চা বিক্রেতাসহ সবার খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে শীঘ্রই ঢাকায় ভর্তুকি মূল্যের ১০ টাকা কেজির চাল ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। ইতোমধ্যে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় সারাদেশের ৫০ লাখ পরিবার ১০ টাকা কেজির চাল পাচ্ছেন।
আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা ॥ সব ধরনের পণ্যসামগ্রী আমদানি ও রফতানিতে সরকারী সংস্থা বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দ্রুত এলসি নিষ্পত্তি, বন্দর থেকে পণ্যখালাস এবং ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।