বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহামারীর সময় শেকসপিয়ারের শিক্ষা




টুইটার আমাদের ব্যঙ্গাত্মকভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, মহামারীকালে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় উইলিয়াম শেকসপিয়ার ‘কিং লিয়ার’ লিখেছিলেন। তার খানিকটা সুবিধা ছিল- তার জীবনে বয়ে গিয়েছিল মহামারী।

১৫৬৪ সালে স্ট্রাটফোর্ড-আপন-এভোনের হলি ট্রিনিটি চার্চে ধর্মীয় রীতি অধ্যয়নে শেকসপিয়ারের অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রেজিস্ট্রার শোনালেন- ‘এখানে মহামারী শুরু হয়েছে’।

নগরটির মৃত্যুহার হয়ে পড়েছে মহামারীমুক্ত আগের বছরের চেয়ে চারগুণ বেশি। শহরের দস্তানা বিক্রেতার ছেলে শেকসপিয়ার এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন এবং আরও কয়েকটি মহামারী থেকেও তিনি রক্ষা পেলেন। তার বেশিরভাগ কালজয়ী রচনা তৈরির সময় যদিও লকডাউন অবস্থা ছিল না; কিন্তু সে সময়গুলো ছিল সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা জানা না থাকা উচ্চমাত্রার সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কাল।

১৫৯২-৯৩ সালে যখন এক মহামারীর কারণে থিয়েটারগুলো বন্ধ ছিল, তখন উদীয়মান নাট্যকার শেকসপিয়ার তৈরি করেছিলেন তার খুবই সফল দুটি কবিতা : এক. ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’।

এটি খুবই সুন্দর কামোদ্দীপক একটি কবিতা, যেখানে দেবী ভেনাস তাকে তুলে দেন অনিচ্ছুক অ্যাডোনিসের হাতে। দুই. ‘দ্য রেপ অব লুক্রিস’। এতে নীতিবানভাবে যৌন নিপীড়নের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

ফের ১৬০৩-০৪ সালে যখন মহামারী নতুন রাজা প্রথম জেমসের অভিষেক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিল এবং লন্ডনের প্রতি পাঁচজনের একজন মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, তখন শেকসপিয়ার সম্ভবত লিখলেন তার নাগরিক দুর্নীতির গবেষণা- ‘মেজার ফর মেজার’।

১৬০৬ সালে মহামারীর প্রাদুর্ভাবের সময় শেকসপিয়ার সম্ভবত ‘কিং লিয়ার’ নিয়ে ভালোভাবে কাজ করছিলেন। তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় এদিক থেকে যে, ট্র্যাজেডিটির প্রথম পারফরম্যান্স হয় হোয়াইটহল প্রাসাদে; যেটি ছিল টিউডোর ও স্টুয়ার্ট ইংলিশ সম্রাটদের লন্ডনের প্রধান আবাসস্থল।

একই বছর ‘অন সেন্ট স্টিফান’স নাইটস ইন ক্রিসমাস হলিডেজ’ রচনা করেন তিনি। নাটকটিতে যদিও রোগের প্রভাব পড়েছে পরোক্ষভাবে; কিন্তু এতে মহামারীর অনেক রেফারেন্স আছে, যেগুলোতে সময়জুড়ে সুনির্দিষ্ট অনেক কিছু হারানোর কথা আছে এবং সেগুলো অনেক লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

লিয়ার তার কন্যা রিগান ও তার স্বামী কর্নওয়ালকে অভিশাপ দিয়েছেন ‘প্রতিহিংসা, মহামারী, মৃত্যু, বিশৃঙ্খলা’ ইত্যাদি বলে এবং তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন ‘আমার দুর্নীতিগ্রস্ত রক্তে/মহামারীকাতর শবচেরাগ’ হিসেবে।

মহামারীকাতর বলে রক্তিম লালাগ্রন্থিকে বোঝানো হয়, যাকে রোগের ভীতিকর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি এমন কোনো বিষয় যে কোনো বাবা-মা তার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করবেন। সম্ভবত নাটকটির বিশেষ সহিংসতা তরুণ প্রজন্মের ওপর খোদ মহামারীর রূপকাশ্রয়ী হয়ে এসেছে : রোগটি খুবই বেপরোয়ভাবে আক্রান্ত করেছে ২০ ও ৩০ বছরের মধ্যে যাদের বয়স ছিল তাদের।

দেখা যাচ্ছে, শেকসপিয়ার খুব ভালোভাবে সক্ষম ছিলেন তার তাৎক্ষণিক পরিপ্রেক্ষিতকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে। সব জায়গায় মহামারী; কিন্তু তার কর্মে এবার সেটি একেবারেই নেই। ‘কিং লিয়ার’ ও অন্যান্য নাটকের ভাষায় এটির উপস্থিতি সর্বব্যাপী- কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অনুপস্থিত।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নারী ও পুরুষ যে কোনোভাবেই মারা যেতে পারে। ‘ওথেলো’তে ডেসডেমোনাকে তার বিছানায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। ‘টিটাস অ্যানড্রোনিকাসে’ ধর্ষক চিরোন ও ডেমেট্রিয়াস তাদের গলনালি কেটে ফেলে এবং সেগুলো পেস্ট্রি বানিয়ে ফেলে।

জন অব গাউন্ট বৃদ্ধ বয়সে মারা যায় তার নির্বাসিত পুত্র দ্বিতীয় রিচার্ডের অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। ‘হেমলেটে’ ওফেলিয়া পানিতে ডুবে মারা যায়।

কিন্তু শেকসপিয়ারের নাটকে কেউই মহামারীতে মারা যায় না। ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’, যারা কিনা কোয়ারেন্টিন পরিস্থিতির কারণে উত্তর ইতালিতে খ্রিস্টান যাজকের চিঠি আটকা পড়ার কারণে মারা যায়। এগুলোই শেকসপিয়ারের কর্মে মহামারীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শেকসপিয়ার যেমন সমসাময়িক লন্ডন নিয়ে কোনো নাটক শুরু করেননি, তেমনি তিনি নিজের নাটকে তার সমাজের কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তির আকস্মিক মৃত্যুর কারণও তুলে ধরেননি। ডকুমেন্টারি রিয়ালিজম শেকসপিয়ারের স্টাইল ছিল না।

অন্যান্য সাহিত্য শাখা ও লেখকদের বেলায়, বিশেষত শেকসপিয়ারের সমসাময়িক নাট্যকার ও পাম্পলেট রচয়িতা টমাস ডেকার- যিনি মহামারীর ওপর জ্বরসংক্রান্ত উদ্ভাবনী সিরিজ ও বিদ্রুপাত্মক গদ্য পাম্পলেট লিখেছেন, অথবা কবি ও নাট্যকার বেন জনসন, যার নাটক ‘দ্য আলকেমিস্টে’ মহামারীর সময় লকডাউন অবস্থায় একটি বাড়ির ম্যানিক শক্তির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে মালিক বাইরে থাকার সময় বাড়ির দায়িত্ব ছিল কর্মচারীর ওপর। এগুলোতে ১৭ শতাব্দীর সমাজে মহামারীর সরাসরি প্রভাব আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাই।

শেকসপিয়ার ব্যতিক্রমী কিছু কাজ করেছিলেন। ফরাসি ক্রিটিক (সাহিত্য সমালোচক) রেনে জিরারড বিখ্যাত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মহামারীর বৈশিষ্ট্য হল এটি চূড়ান্তভাবে সব ধরনের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে ফেলে।’ মহামারীতে মৃতদের জন্য খোঁড়া গণকবর ছিল একদা কীভাবে রোগটি সামাজিক, লৈঙ্গিক ও ব্যক্তিগত ভেদাভেদ ভিন্নতায় সবকিছু ধ্বংস করেছিল, তার প্রতীক।

ডেকার উল্লেখ করেছেন, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কবরে লেখা ছিল- ‘ভৃত্য ও মুনিব, নোংরা ও পরিচ্ছন্ন / একজন রাজভৃত্যের পোশাক পরিহিত এবং তার পরবর্তীরাও।’ সমাজ সৃষ্ট দেয়ালের ব্যাপারে মহামারী ছিল উদাসীন এবং এর ক্ষুধা ছিল রাক্ষুসে। হাজারও স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানকে চলে যেতে হয়েছে সমাধির দিকে। ডেকার একে স্মরণ করেছেন এভাবে যে, ‘মনে হয় তারা চলে গেছে এক বিছানায়।’

মধ্যযুগের শেষের দিকের সংস্কৃতিতে সাধারণ একটি প্রতিচ্ছবি, যা ‘তাণ্ডবনৃত্য’ হিসেবে পরিচিত; এতে মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়েছে একটি কঙ্কালের আকৃতিতে, যেটি অশালীনভাবে জীবিতদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। সে অদৃশ্যভাবে আছে তাদের সঙ্গে বেডরুমে, টেবিলে, রাস্তায় এবং কাউন্টিং হাউজে।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম

ইমা স্মিথ : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শেকসপিয়ার স্টাডিজের প্রফেসর

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: