সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিক; হলুদ সাংবাদিকতা কিংবা হোয়াট ইজ নিউজ




আমিনুল ইসলাম রোকন

 

ভাই আমারে চিনেন নাই
– না পরিচয়টা দেবেন প্লিজ
আমিও তো সাংবাদিক
-ও আচ্ছা, তা কোথায় কাজ করেন
কাজ করিনা, আমি নিজেই মালিক সম্পাদক
– ও তাই
হুম, আমার সাইট দেখেননাই, অনেক জনপ্রিয়। ভিউয়ারও অনেক বেশি। নিউজ আমারটাতেই সবার আগে আপলোড হয়।
– তা আপনার সাইটের নাম কি?
ওই যে ………. টুয়েন্টিফোর.কম
– ও আচ্ছা ভালো।

আমার সাংবাদিকতা আর কবিতার গুরু একদা বলেছিলেন মিডিয়ার আকাশে এখন আর পাখিদের বিচরণ নেই, শুধুই মশা-মাছি।
ইদানিং হাটে-ঘাটে এরকম কিছু মশা-মাছিদের সাথে দেখা হয়। উপরে উল্লেখিত কথোপকথনের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই।
জীবনেও সাংবাদিকতার পাঠ নেননি তারা এখন সরাসরি সম্পাদক। নেট দুনিয়ার ডোমেইন সিস্টেম সম্পাদক সাজার পথটি খুব সহজ করে দিয়েছে। ভয়ানক বিষয় হলো এরকম সম্পাদকের সংখ্যা আর তাদের প্রাদুর্ভাব সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের মতোই বেড়ে চলেছে। কোথাও এদের দেখা মিললে এরা সবাই প্রায় একই ধাচে কথা বলে। এদের কোয়ালিটি প্রায় সিমিলার। কুনো প্রাকার শুনার আগ্রহ না দেখালেও এরা তাদের সম্পাদকীয়তা অনর্গল জাহির করতে থাকেন। মজার বিষয় হলো- আগে কোথায় কাজ করেছেন – এই প্রশ্নটি করলেই এরা থমকে যায়। আর এগুতে পারেনা।
আমার আফসোস হয় কত সহজে এরা এক লাফে সাংবাদিকতার শীর্ষ পদবি পেয়ে যাচ্ছে। পেয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে, বলতে হবে নিজেই নিজেকে পদায়ন করে নিচ্ছে। অথচ আমারা যারা শুদ্ধ সাংবাদিকতার চর্চা করতে চাচ্ছি, শিক্ষানবিস থেকে রিপোর্টার হতে কতনা সংগ্রাম, কত চড়াই উৎরাই করতে হয়েছে আমাদের। আমার এখনো মনে আছে- আমরা শিক্ষানবিশ হিসেবে ছয়মাস কাজ করেছি। হাতে কলমে আমাদের সাংবাদিকতা শিখানো হয়েছে। যেখানে নিউজ কি তা জানার আগে প্রমিত বাংলা, শব্দ চয়ন, বাক্য গঠনের কৌশল কিংবা প্রাঞ্জলতাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার শিক্ষাকে। আমরা যারা মিলিনিয়াম সময়ের শুরুতে সাংবাদিকতায় এসছি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। শিক্ষানবিশ থেকে স্টাফ রিপোর্টার হওয়ার পর প্রতিদিন যে রিপোর্ট করতাম তা প্রথমে যেতো চীফ রিপোর্টারের ডেস্কে। চীফ রিপোর্টার রিপোর্টি কাটাছেরা করতেন পোস্টমর্টেমের মতো। প্রথম দিকে লাইনে লাইনে এডিট হতো। এর পর রিপোর্টটি যেতো বার্তা সম্পাদকের টেবিলে। সে সময়ের বার্তা সম্পাদকরা একটু বয়সী এবং কড়া মেজাজের ছিলেন। নিউজে ভুল থাকলে চশমার ফাক দিয়ে তাকিয়ে বকাঝকা শুরু হতো।”কি লিখছ মিয়া এইসব আগডুম বাগডুম। শব্দ চয়ন ঠিক নাই, বাক্য গঠন ঠিক নাই, নাই প্রাঞ্জলতাও”। পড় না কেন। বেশি বেশি কাগজ আর সাংবাদিকতার বই পড়বা। যত পড়বা ততো ঠিক হবে লিখা- নিউজ এডিট করতে করতে বকাবকির সাথে এমন উপদেশও থাকতো বার্তা সম্পাদকের।
সাংবাদিক কিংবা সাংবাদিকতার নির্দিষ্ট একটি অবকাঠামো আছে। যে কেউ চাইলেই সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক হয়ে যেতে পারেননা। সাংবাদিক হতে গেলে প্রথমেই আপনাকে অবকাঠামো যুক্ত কুনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ হতে হবে। হোক সেটা মুদ্রণ কাগজ, টিভি চ্যানেল, রেডিও, কিংবা অনলাইন নিউজ পোর্টাল। শিক্ষানবিশ থাকা অবস্থায় আপনার কাজ আপনার মেধা আর সক্ষমতা কর্তৃপক্ষের কাছে পছন্দসই হলে আপনি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে নিযুক্ত হবেন। আপনার দক্ষতাসম্পন্ন কাজ আর নৈতিক মান যত বাড়বে আপনার পদায়নও ততো হবে। এই ধরুন রিপোর্টার থেকে সিনিয়র রিপোর্টার সেখান থেকে ধীরে ধীরে ডেপুটি চীফ রিপোর্টার, চীফ রিপোর্টার, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, সব শেষে সম্পাদক। একজন সাংবাদিকের সম্পাদক পদবী পর্যন্ত পৌছাতে পুরো একজীবন লেগে যাওয়ারই কথা।
কিন্তু যন্ত্র-যন্ত্রনার এই যুগে সম্পাদক হতে এখন আর পুরো জীবন অপেক্ষা করতে হয়না। প্রয়োজন হয়না সাংবাদিকতার আদি পাঠের।অবকাঠামো গত প্রক্রিয়ারও প্রয়োজন হয়না এখন। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে নেট থেকে ডোমেইন কিনে রেডি ডিজাইনের একটি সাইট এনে সম্পাদক হিসেবে নাম বসিয়ে দিলেই ব্যস। মুদি দোকান কিংবা পান দোকান খুলা যত সহজ। নিউজ পোর্টাল খুলা, সাংবাদিক হয়ে ওঠা আরো অনেক সহজ। অসুস্থ এক প্রতিযোগিতা চলছে বর্তমানে। যার খুশি, যেমনে খুশি সবাই সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন। আমুক তমুক টুয়েন্টিফোর ডট কম বানিয়ে সম্পাদক সাজছেন। কে কার আগে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হবেন চলছে লাগামহীন প্রতিযোগিতা। কুনো প্রকার প্রক্রিয়া ছাড়া নিজে নিজে সাংবাদিক আর সম্পাদক হয়ে ওঠা এবং সাংবাদিকতার আদি পাঠ না থাকার কারণে – কুনটা নিউজ আর কুনটা নিউজ নয় এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও থাকেনা অনেকের। যে কারণে হলুদ সাংবাদিকতাইই তাদের মূল পুঁজি হয়ে পড়ছে।
উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপন তাদের কাছে পেশা নয় বরং মদ গাজার মতো খারাপ নেশা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাংবাতিকতায় ভালমত গবেষণা বা খোঁজ-খবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। এসব হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্যই হলো সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানো। ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকৰ্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্ৰতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্ৰচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি করে সমাজে ভ্রান্তি সৃষ্টি করাই এদের মূল উদ্দেশ্য।
কালজয়ী সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক লুথার হলুদ সাংবাদিকতার কিছু বৈশিষ্ট্য জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হলুদ সাংবাদিকতা হলো-
সাধারণ ঘটনাকে বড় আকারে উপস্থাপন আর চমক সৃষ্টি করতে ভয়ানক শিরোনাম করা।
ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার করা
সংবাদ যোগ্য নন এমন কারো ভুয়া সাক্ষাৎকার নেয়া
সমাজে ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন সংবাদ ছাপানো ,
ভুয়া আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক মতামত ছাপানো – যারা প্রকৃতপক্ষে কুনো বিশেষজ্ঞ নন।
স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের প্ৰতি নাটকীয় সহানুভূতি।
লুথারের এই সবগুলো বৈশিষ্টই বর্তমান অশিক্ষাপটু সাংবাদিকতার মূল পুঁজি।
এখানে এসে হলুদ সাংবাদিকতার বাস্তব গল্পটি বলার লোভ সামলাতে পারছিনা- হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম হয়েছিল সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই কিংবদন্তি জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে পেশাগত প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে। দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের। এই দুই সম্পাদক তাদের নিজ নিজ পত্রিকার ব্যবসায়িক স্বার্থে একে অপরের অপেক্ষাকৃত যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কর্মচারীদের অধিক বেতনে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত কেলেংকারির চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে তারা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন। পুলিৎজারের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও হার্স্টের নিউ ইয়র্ক জার্নালের মধ্যে পরস্পর প্রতিযোগিতা এমন এক অরুচিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য আর পাঠকদের উত্তেজনা দানই তাদের নিকট মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। একসময় তারা বুঝতে পারেন ভয়াবহ নগ্ন এবং অসুস্থ প্রতিযোগীতায় মত্ত হয়ে পড়েছেন তারা। নিজেদের দুর্নাম এতোবেশি ছড়িয়ে পড়েছিলো যে বাধ্য হয়ে তারা সাংবাদিকতার সুস্থ ধারায় ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছলো। পাঠক তাদের হলুদ সাংবাদিকতাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলো বেশ। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তাদের কাগজ থেকে। পুলিৎজারের মৃত্যুর পর অবশ্য সুনাম ফিরানোর চেষ্টা করেছিলেন তার অনুসারীরা। পুলিৎজার পুরস্কারের আয়োজন করে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলো। যে কারণে পুলিৎজারকে এখনো সাংবাদিকতার নোবেল প্রাপ্তিই বলা হয় সারা দুনিয়ায়।
পুলিৎজার জাত সাংবাদিক ছিলেন। নেশায় পড়ে হয়তো অসুস্থ আর হলুদ সাংবাদিকতায় পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু সাংবাদিকতার আদি পাঠ থাকায় সুস্থ ধারায় ফিরেছিলেন। পুরো রাষ্ট্রকে জানিয়েছিলেন হলুদ সাংবাদিকতা দেশ এবং সমাজের ক্যান্সার সরূপ। কিন্তু আমাদের দেশে যারা এমন সাংবাদিকতা করছেন, নিজে নিজে সম্পাদক হচ্ছেন তাদের থামাবে কে? যারা সাংবাদিকতার কুনো পাঠ না নিয়েই সাংবাদিক, সম্পাদক হয়ে গেছেন তাদের কে শেখাবে সাংবাদিকতার সুস্থ ধারা? নীতি, নৈতিকতা?

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: