শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Sex Cams

আমাদের পুলিশ কি ইমেজটা ধরে রাখতে পারবে




মো. আব্দুর রব

শিশুরা ছোট বেলা থেকে পুলিশের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বড় হয়। অনেক শিশু স্বপ্নও দেখে বড় হলে তারা পুলিশ হবে। অনেকে হাতে ডান্ডা নিয়ে অথবা খেলনা বন্দুক নিয়ে পুলিশের ভূমিকায় অভিনয় করে। ছোট বেলায় ‘চোর-পুলিশ’ খেলাটি খেলেনি এমন শিশু সম্ভবত একটিও পাওয়া যাবেনা। কিন্তু আস্তে আস্তে শিশুরা যখন বড় হয় পুলিশের প্রতি তাদের সেই শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসায় ভাটা পড়তে থাকে। এক সময় তারা পুলিশের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।

আমার নিজেরও ছোট বেলায় পুলিশের প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। ভাবতাম পুলিশ হতে পারলে কি মজা। সবাই আমাকে ভয় পাবে। যাকে ইচ্ছা যখন তখন ধরে পিটিয়ে লম্বা করে ফেলতে পারব। পরে যখন বুঝতে পারলাম আমাদের দেশের অপরাধ জগতটা পুলিশের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। বহুলাংশে পুলিশ অপরাধ দমনের চাইতে অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতাই করে বেশি। পুলিশ জনগণের হতে পারেনা। পুলিশ হয় ক্ষমতাসীন দলের।

আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’। এই প্রবচনটি পুলিশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গির প্রকাশ। আমাদের সমাজে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে মুরব্বিরা থানা পুলিশ না করার পরামর্শ দেন। তারা স্থানীয় ভাবে বিষয়টি ফয়সালা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কারণ তারা ভাবেন পুলিশের আশ্রয় নিলেই বাদি বিবাদী উভয় পক্ষই ফতুর হয়ে যাবে। তাদের অভিজ্ঞতা ভুল নয়। বাস্তবে ঘটতও তাই। এজন্য মানুষ পুলিশ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। আমার চোখের সামনেই গ্রামের অনেক সহজ সরল মানুষকে মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হতে দেখেছি। পুলিশ বাদী বিবাদী উভয় পক্ষ থেকেই দেদারসে টাকা খায়। তাই অনেক মানুষ নীরবে জুলুম নির্যাতন সহ্য করলেও পারতপক্ষে পুলিশের ধারস্ত হয়না।

ক্রমেই পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হতে লাগল। পুলিশের সকল প্রশংসনীয় কাজ গুলো তাদের সীমাহীন দুর্নীতি এবং অপকর্মের আড়ালে চাঁপা পড়ে গেল। যত বড় হলাম শুধু পুলিশের নেতিবাচক দিকটাই চোখে পড়ল বেশি। এক সময় দেখলাম ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ও পুলিশের মধ্যে কোনো পার্থক্য রইলনা। অপরাধ জগতে তারা যেন একে অপরের পরিপূরক। তাদের সম্মিলিত চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি যেন সকল মাত্রা অতিক্রম করল। জাতির আশা ও ভরসাস্থল পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত হতে লাগল ভয়ংকর সব অপরাধ। সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চাঁদা দাবি করা, সহজ সরল কারো পকেটে ইয়াবা গুঁজে দিয়ে অথবা হাতে পিস্তল ধরিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া, খুন গুম ধর্ষণ ও সীমাহীন ঘুষ গ্রহণ সহ হেন অপরাধ নেই যেখানে পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলনা। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক যখন নির্যাতনের শিকার হয়ে পুলিশের আশ্রয় নেয় আর সেখানে গিয়ে আরেক দফা হয়রানির শিকার হয় তখন ঐ মানুষটির মতো অসহায় সম্ভবত পৃথিবীতে আর কেউ থাকেনা। বিষয়টি কতটা কষ্টদায়ক ও মর্মান্তিক ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে।

শেষ পর্যন্ত করোনা নিয়ে এল পুলিশের হারানো গৌরব ও প্রকৃত ইমেজ ফিরিয়ে আনার এক অপূর্ব সুযোগ। আমাদের পুলিশ সেই সুযোগ হাতছাড়া করলনা। তাদের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মানব সেবায়। দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। প্রমাণ করল সেবাই পুলিশের ধর্ম। আর পুলিশ যে আসলেই জনগণের বন্ধু, তাদের বেশকটি তাজা প্রাণের বিনিময়ে এই সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল। করোনা পরিস্থিতি সারা বিশ্বকে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন করে ভাবিয়েছে, নতুন পথ দেখিয়েছে। লকডাউনের দিন গুলোতে সম্পূর্ণ এক নতুন চেহারা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সামনে হাজির হয়েছে পুলিশ।

পুলিশের কর্মতৎপরতা সারা দেশের আপামর জনসাধারণের নজর কাড়ল। সম্ভবত এই প্রথম বারের মতো আমাদের পুলিশ বাহিনী দেশ ও জাতির সেবায় সত্যিকারের মানসিক ইচ্ছা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরা নতুন করে চিনতে শুরু করলাম পুলিশকে। এরা যেন আমাদের পুলিশ নয়। যেন উন্নত কোনো রাষ্ট্রের গল্পে শোনা পুলিশ বাহিনী। এই জোয়ারে ভেসে গেল পুলিশ নিয়ে মানুষের মনে তৈরি হওয়া এত দিনের ক্ষোভ, অনাস্থা আর অবিশ্বাস। জাতির এই চরম দুঃসময়ে মানুষ তাদের পাশে খুঁজে পায় পুলিশ।

মানুষকে ঘরে রেখে রাস্তায় থাকে পুলিশ। জীবনের চরম ঝুঁকি থাকা সত্বেও তারা রাস্তা ত্যাগ করেনা। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা খাবারের প্যাকেট হাতে পুলিশ পৌঁছে যায় মানুষের দ্বারে দ্বারে। কেউ রাতের আঁধারে ক্ষুধার্ত মানুষকে দেয় খাবার, কেউ অসুস্থ রোগীকে পৌঁছে দেয় হাসপাতালে। করোনা সংক্রমণে মৃত ব্যক্তির আশে পাশে যখন মৃতের নিকটাত্মীয়রা পর্যন্ত ঘেঁষতে চাননা তখন পুলিশ করে সৎকার। এজন্য এখন পর্যন্ত হাজারের উপর পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন।

করোনাকালীন পুলিশের এই তৎপরতা পুলিশ সম্পর্কে আমাদের চিরাচরিত ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। পুলিশ বাহিনী তাদের একাগ্রতা ও নিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে এক নতুন ইমেজ। জয় করে নিয়েছে কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়। স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। পুলিশের সীমাবদ্ধতা ও নানা অসহায়ত্ব আমাদের অজানা নয়। এতদসত্বেও এই করোনা যুদ্ধে তারা যে বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে অতুলনীয় অবদান রেখেছে তা জাতি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবে।

আমরা চাই করোনা পরবর্তী সময়ে পুলিশ যেন আবার যথাস্থানে ফিরে না যায়। এখনকার মতো পুলিশ সদা সর্বদা যেন আমাদের পাশে থাকে। আমাদের বন্ধু হয়েই থাকে। আমাদের হৃদয়ের যে স্থান তারা দখল করে নিয়েছে তা যেন আবার শূণ্যতায় ভরে না উঠে। বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর এই গর্বিত পথ চলা যেন আর কোনো কালো হাত দ্বারা কলুষিত না হয়। এত ঝুঁকি, এত ত্যাগ, এত কষ্ট করে যে ইমেজ পুলিশ তৈরি করেছে তা যেন বিনষ্ট না হয়, সেদিকে পুলিশকেই কড়া নজর রাখতে হবে। পুলিশ যেন আমাদের সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন আমাদের মতো পুলিশের প্রতি আস্থা না হারায়। একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় থাকলাম।

মো. আব্দুর রব: ব্লগার, কলামিস্ট।
রোম, ইতালি।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: