বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারি’র জানাজা ও কিছুকথা




ইমন শরীফঃ

এইসময়ের লিপজলমার্কা ট্রেডিলেডি তথাকথিত আল্লামা/মাওলানাদের ভীড়ে যে কয়েকজন হাতেগোনা মুফাসসিরে কুরআন সঠিক ও নির্ভুলভাবে কুরআনের তাফসির করেন নিঃসন্দেহে প্রখ্যাত মুফাসসির মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
ইসলাম তথা কুরআন-হাদিসের নাম ভাঙিয়ে কোনো বিতর্কিত বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইচ্ছাকরে কোনোদিন ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করেননি । অনলাইনে আলোচনা-সমালোচনার পাত্র হয়ে নিজেকে খুব বেশি পরিচিত করতে চাননি-যেটা ইদানীং আমরা অহরহ দেখছি।
তিনি একদিকে যেমন সুললিত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন,অন্যদিকে ছিলেন তাত্ত্বিক বিশ্লেষকও সারগর্ভ আলোচক। তাকে এমন ওয়াজ করতে কমপক্ষে আমি দেখিনি,যেওয়াজ বিভাজন তৈরি করতো,সংঘর্ষ বাধাতো। তার ওয়াজে শান্তির সুবাতাস বইতো,মানুষকে নিয়ে যেতো ভাবনার ওপারে। দলীয় ওয়াজও তাকে করতে দেখিনি,যদিও তিনি একটিদলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। মানুষ হিসেবে তিনি একটি মতও পথের অনুসারী হতে পারেন,এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়;কিন্তু তার মাঝে অসাধারণ মানবিক গুণাবলি বিদ্যামান ছিল-তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
এককথায় বললে তিনি একজন নির্লোভ, সৎ ও খাঁটি আলেম ছিলেন, যা তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই বলে দেয়। বিশেষকরে প্রতিটি ওয়াজের শেষে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মুনাজাত উপস্থিত সকলের চোখকে মুহূর্তেই নদী বানিয়ে ফেলতো,যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজেও কয়েকবার। যিনি প্রতিটি দোয়ায় বারবার একটি বাক্য বলতেন-“হে আল্লাহ শুক্রবারে নামাজের সেজদায় তুমি আমাদের মরণ দিও”।
মহামারী করোনার নগ্নথাবায় বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত। এক অঘোষিত অদৃশ্য যুদ্ধে মানবতা যখন বিপন্ন। করোনার ভয়াল সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর প্রায় সকলমানুষ যখন স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারান্টাইনে একধরনের বন্দিজীবন অতিক্রম করছে। কার্যত লকডাউনে পৃথিবী যখন অচলপ্রায়।
মসজিদ,গির্জা,মন্দিরসহ সকল উপাসনালয় যখন বন্ধ বললেই চলে, ঠিক সেই ক্রান্তিলগ্নে গত ১৭/০৪/২০২০ খৃস্টাব্দ তারিখে তার সেই আকাঙ্ক্ষিত শুক্রবারেই আনসারী সাহেব ইন্তেকাল করেন।
লকডাউন উপেক্ষা করে প্রায় দেড়লাখ মতান্তরে প্রায় আড়াইলাখ মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে, টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদে দেখলাম ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রায় দশ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে জানাজার বিস্তৃতি ঘটেছিল, লকডাউন না হলে যা পঞ্চাশলক্ষ ছাড়িয়ে যেতো বলে অনেকেরই ধারণা।
অথচ এইসময়ে বিপুল মানুষের উপস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়, ধর্মীয় বিধিবিধানও দেশের আইনে মারাত্মক অপরাধও বটে।
তাই তার এই জানাজাকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
যারা লকডাউন ভেঙে তার জানাজায় বিপুল উপস্থিতির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ইসলামি শরিয়ায় জানাজার স্বাভাবিক বিধান কী?
উত্তরে অবশ্যই বলবেন ফরজে কেফায়া।
আবার যদি জিজ্ঞেস করি ফরজে কেফায়া কী?
উত্তরে অবশ্যই বলবেন,যা কয়েকজন মানুষ আদায় কর নিলেই উম্মতের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়।
তাহলে এখন আপনারাই বলুন, মহামারী করোনার এই অস্বাভাবিক মুহূর্তে যখন মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার সমূহ আশংকা বিদ্যমান,ঠিক সেই মুহূর্তে আপনাদের এই বিশাল জনসমাগম শরিয়ায় ভেতরে না বাইরে?
মহানবী(সাঃ)এর নির্দেশনার অনুকূলে না প্রতিকূলে?
যদি প্রতিকূলে হয়,তাহলে তা আপনি/আপনারা চাপার জোরে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন কেন?
কেন ইসলামের সুন্দর বিধিবিধানকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন? কেন? কেন? এবং কেন?
এই মহামারীকে উপেক্ষা করে আপনারা তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে তার কোনো উপকার করতে পেরেছেন বলে মনেহয়? অথবা আপনারা কোনো সওয়াব অর্জন করেছেন বলে মনে করেন?
নিশ্চয় এবং নিশ্চয়ই না। বরং শরীয়ার নির্দশে অমান্য করে তার জানাজায় এই করুণ সময়ে উপস্থিত হওয়ার দরুন তার আত্মা আপনাদের প্রতি যে অসন্তুষ্ট হয়নি- তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? ইসলামি শরিয়ার বিধানও দেশের আইনে আপনারা যা করেছেন, তা মূলত অপরাধ এটা কি অস্বীকার করতে পারবেন?

আর যারা কেবল আনসারি সাহেবের জানাজাকে ঘিরে একেরপর এক বিরূপ মন্তব্য করছেন,তাদের প্রতিও আমার প্রশ্ন
আপনারা কী মনে করেন বাংলাদেশ কার্যত লকডাউন?
যদি বলেন হ্যাঁ,তাহলে আবারো প্রশ্ন কীসের লকডাউন?
কার্যত লকডাউন হলে বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া গিয়ে আনসারী সাহেবের জানাজায় অংশগ্রহণ করে কীভাবে? কার্যত লকডাউন হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গার্মেন্টস কর্মীরা কীভাবে ঢাকায় আসে? কীভাবে দেশের রাজধানী কাওরানবাজারের অবস্থা এমন হয়? কীভাবে দেশের আনাচেকানাচে এখনও হাটবাজারের প্রতিটি দোকান খোলা থাকে? কীভাবে এখনো পরিলক্ষিত হয় জমজমাট আড্ডাও খেলার আসর?
ত্রাণ বিতরণের নামে গণজমায়েত করে সেলফিবাজি
করলে কী করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না?
গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ করলে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হবে না?
বেগম খালেদাজিয়ার জামিনে মুক্তির সময়ে নেতাকর্মীরা ভীড় জমালে করোনার সংক্রমণ ঘটে না?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রকাশ্য দিবালোক মিছিল দিয়ে পা কেটে দলবেঁধে উল্লাস করলে করোনা সংক্রমণ ঘটে না?
যাত্রী ভরপুর চলন্ত ট্রেন থেকে কী করোনার সংক্রমণ ঘটে না? মন্ত্রীর প্রেসব্রিফিংকালে একজনের সাথে আরেকজনের গা ঘসানো থাকলে করোনার সংক্রমণ ঘটে না? লঞ্চভরা যাত্রীর কী করোনায় সংক্রমিত হওয়ার কোনো আশংকা থাকে না?

তার মানে কী লকডাউন মানে আপনারা কেবল মসজিদে জামাতে নামাজপড়া আর জানাজায় অংশগ্রহণের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারিকেই বুঝেন?
আপনারা কী নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন লকডাউন ভেঙে এতো মানুষকে আনসারির জানাজায় জমায়েত করার পেছনে কারো হাত ছিল? তার পরিবার জানাজায় শরিক হওয়ার আহবান করেছিল প্রমাণ দিতে পারবেন? বরং প্রশাসন বলছে আমরা মাইকিং করে লোকদের জানাজায় অংশগ্রহণ নাকরার জন্য আহবান করেছি। এতোকিছুর পরও যদি কেউ জানাজায় চলে যায় এটার জন্য আপনি/আপনারা কাকে দায়ী করবেন? আর এদেরকে দায়ী করা থেকে আমি মনেকরি এরা গেল কীভাবে এবিষয়টি নিয়ে ভাবা। আর সামনে যাতে এভাবে করোনা কালে কোনো গণজমায়েত হতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপকরা।
আর একটি কথা মনে রাখবেন গোঁড়ায় পানি না ঢেলে শাখাপ্রশাখায় ঢেলে কোনো লাভ নেই। সমস্যার মূলে প্রবেশ না করে কেবল তার শাখাপ্রশাখায় বিচরণ করলে সমস্যা কখনো দূর হবে না।
দোহাই খোদার! সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে শিখুন,একচোখা নীতি পরিহার করুন।
হ্যাঁ স্বীকার করি আপনি একটি ধারার রাজনীতি বা আদর্শের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত,তার মানে এই নয় যে,আপনার মাথাটা কেবলমাত্র সেইধারাটাকেই সঠিক মনে করবে,আর বাকি সকলধারাকে অসম্মান করবে,একটু সুযোগ পেলেই তাদের বারোটা বাজানোর ধান্ধায় লিপ্ত হবে। না! তা কখনো সঠিক হতে পারে না।
আপনি/আপনারা অবশ্যই আলোচনা-সমালোচনা করবেন,তবে শর্ত হলো,তা হতে হবে গঠনমূলক, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ইচ্ছে থেকে সমালোচনা দেশও জাতির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না,বরং তা অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনবে,এটাই সত্য।
আমি বলবো কী! বিশ্বের এই ক্রান্তিলগ্নে,মানবতার এই চরম বিপর্যয় ক্ষণে আসুন আমরা প্রত্যেকেই কেবল আমাদের দলও বলয় নিয়ে চিন্তা না করে,আমাদের মতও ধারাকে প্রাধান্য না দিয়ে সামগ্রিকভাবে মানুষের কথা চিন্তা করি। মানুষের কাছে ধর্মীয় ভেদাভেদ,দলীয় সংকীর্ণতাও বলয়ের প্রভাব সৃষ্টির চিন্তা দূরীকরণের বার্তা পৌছাই। মানুষ কে বলি,ধর্ম তো মানুষের জন্যই,মানুষ না থাকলে কে ধর্ম পালন করবে। মানুষকে বলি মত,পথও দর্শন,রাজনীতি তাও তো মানুষের জন্য, মানুষ না বাঁচলে এগুলো কে করবে? মানুষকে বুঝাতে চেষ্টা করি সময় এখন বিভেদের নয়,বরং ঐক্যবদ্ধভাবে অদৃশ্য এই প্রাণঘাতী ভাইরাসযুদ্ধ মুকাবেলাকরাই হালের অপরিহার্য দাবি। আর তার জন্য অবশ্যই অবশ্যই প্রয়োজন কোয়ারান্টাইন তথা সঙ্গনিরোধ থাকা।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: