বিশ্বের অনেক দেশেই গরম পড়তে শুরু করেছে। গরম আবহাওয়ায় যুক্তরাজ্যে লকডাউন রাখা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জনসমাগম আটকানো কর্তৃপক্ষের জন্য বেশ চাপের হবে। এ অবস্থায় কী করণীয় হবে, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, গরম আবহাওয়ায় এই ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা দেখে নতুন কোনো ধারণা পাওয়া সম্ভব। অনেক সংক্রামক রোগের প্রকোপ শীত মৌসুম চলে গেলে বা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কমে যায়। সে রকম সূর্যের আলো কি করোনভাইরাস ও এর বিস্তারকে প্রভাবিত করতে পারবে—এটিই এখন মূল প্রশ্ন। এপিডেমিওলজিস্টরা খুব কাছ থেকে এই পরিবর্তনের দিকে নজর রাখছেন। অনেকে বলেন, মৌসুমি রোগের ক্ষেত্রে যা কাজ করে, মহামারির ক্ষেত্রে অনেক সময় তা প্রযোজ্য হয় না।
ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান–এর অনলাইন একাধিক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই করোনাভাইরাসের আগে যে করোনাভাইরাসগুলো ছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের মানুষদের ঠান্ডা লেগে সর্দি হয়েছে। শীতে ব্যাপক বাড়ত এর প্রকোপ। আবার বসন্ত আসতে আসতে কমে যেত। অদ্ভুতভাবে প্রায় সব ধরনের ফ্লুর ক্ষেত্রে এমনটা হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জাও শীতের মৌসুমে দেখা দেয়, গরম শুরু হলে চলে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌসুম পাল্টালেও সামান্য পরিমাণে সংক্রমণ দেখা গেছে।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানীরা সাধারণ কিছু করোনাভাইরাস যেমন: এইচসিওভি-এনএলসিক্সথ্রি, এইচসিওভি-ওসিফোরথ্রি, এইচসিওভি-টুটুনাইনই নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। বেশ কয়েক বছর আগে সংগ্রহ করা নমুনা বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেছেন, ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাস (আগেরগুলো) সংক্রমণের হার অনেক বেশি, গ্রীষ্মে প্রকোপ খুব কম। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে করোনাভাইরাসগুলো আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আচরণ পরিবর্তন করে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধরনের মতামতের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী জানাচ্ছেন। গবেষক রব আলড্রিজ সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমরা গ্রীষ্মে করোনাভাইরাস সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে দেখেছি, তবে খুবই কম হারে। তবে শীতে এটি আবার বেড়ে যায়। নোভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে আমরা জানি না এটি মৌসুমি প্যাটার্ন ধরে রেখেছে কি না। এ জন্য বর্তমান যে স্বাস্থ্য পরামর্শ জারি আছে, তা অনুসরণ করে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, যার আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয়েছে সার্ক-কোভ-২, একেবারেই নতুন ধরনের একটি ভাইরাস, যেটি সম্পর্কে খুব কম তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এটা ঋতুর সঙ্গে কতটা বদলাতে পারে তা দেখার। তবে শুধু তাপমাত্রা নয়, মানুষের আচরণ, তাদের মেলামেশা, একটি স্থানে কত মানুষ অবস্থান করছে, এ রকম আরও কিছু বিষয়ের ওপর ভাইরাসে বিস্তার নির্ভর করে।
ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট মাইকেল স্কিনার বলেন, ‘আমি নিশ্চিত ভাইরাসের আচরণ ও এর বিস্তার মৌসুমি তারতম্য দ্বারা প্রভাবিত হবে। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে যে প্রভাব ফেলবে, তার তুলনায় এটি খুব সামান্য। এটি কিছু প্রান্তিক প্রভাব ফেলতে পারে তবে স্ববিচ্ছিন্নতার (আইসোলেশন) বিকল্প হবে না।’
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন রিডিং ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট বেন নিউম্যান। তিনি বলেন, এই ভাইরাস শুরু হয়েছিল চীনের একদম হাড় হিম করা আবহাওয়ায়। এখন একদিকে আইসল্যান্ড অন্যদিকে ব্রাজিল, ইকুয়েডরের মতো নিরক্ষীয় অঞ্চলে তা দ্রুত বাড়ছে। শীত শেষ হয়ে বসন্ত আসতে শুরু করল, তারপরও বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসের বিস্তার অব্যাহত আছে। এটি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের মতো নয়, মেঘ সরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো মেশিনও না, একে আমাদের, মানুষকেই মোকাবিলা করতে হবে।’
অন্য গবেষকেরা বলছেন, এটি মানবশরীরের প্রতিরোধব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আনতে পারে। সারে ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট ন্যাটালি রিডেল বলেন, ‘আমাদের ইমিউন সিস্টেম একটি দৈনিক ছন্দ প্রদর্শন করে, তবে মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এটি কেমন আচরণ করে, সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না।’
এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ইমিউনোলজিস্টরা। সারে ও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন মৌসুমে এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে মানুষের শরীরে প্রতিরোধের যে পরিবর্তন হয় তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত বিভিন্ন সময়ের নমুনা নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইমিউন সিস্টেমে মূল ভূমিকা রাখে শ্বেত রক্তকণিকার একটি সাবসেট, যা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বৃদ্ধি পায়। যা ইঙ্গিত করে, যে ইমিউন সিস্টেম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সাড়া দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বি সেল যা মানবদেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেটি রাতে বৃদ্ধি পায়।
তবে মৌসুমের সঙ্গে ইমিউন সিস্টেমের সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক এখন গবেষণাধীন।