শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

Sex Cams

গাঁউগেরাম থাকি বউত্তা আরিযার!




  • ফায়সাল আইয়ূব

গাঁউগেরাম থাকি আস্তে আস্তে আরিযারগি আমরার বউত ঐতিহ্য। যেতা লইয়া আমরার বাপ-দাদাইনতে রীতিমত গৌরব করতা। কবি হকলে কবিতা লেখতা, গাতকরা গান বানাইতা। ইতা ঐতিহ্য আরি যাওয়ার লাগি মূলত দায়ী ‘সময়’। সময়ের বিবর্তনর লগে লগে আমরার অনেক গাঁউগেরাম অখন কারেন্টর আলোয় আলোকিত। আর অউ কারেন্টর কারণে আইজ গাঁউর ঝুফড়ি ঘরোও জ্বলে বাত্তি, চলে শাদা-কালা বা রঙিন টেলিভিশন। ধনী বাড়িনতোর ছাদো দেখা যায় লোয়ার বড় বড় ছাত্তি। গাঁউ থাকি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়রা, ইলা বউত বাড়িত আছে কম্পিউটার। ইতা কম্পিউটার খালি বড়তাইনতেউ চালাইন না, বাড়ির হুরু হুরু হুরুতাইন, যেতা হবে ইশকুলো যাওয়া শুরু করছইন, অতায়ও চালাইন, গেইমিং করোইন, ছবি আঁকিয়া কাটাইদেইন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর অউ লাখান আরো বউত কারণে আমরা আরাইলিরাম পুরানা বউত আচার অনুষ্ঠান, খেলাধুলা আর ব্যবআরি জিনিসপত্র। ইতার জা’গা দখল করিলার আধুনিকতা আর আধুনিক যন্ত্রপাতি।

খড়ম

খড়ম, আইজ থাকি মাত্র ২৫-৩০ বছর আগেও দেখা যাইতো দোকানাইনতর তাকো, বাড়িনতর দাইরো, ছেছিত। দুই লাখান খড়মর চল আছিল। একটা খুঁটিআলা বা ঘুটিআলা বা বৈলাখড়ম আর আরেকটা ফিতাআলা বা চটিখড়ম। খুঁটিআলা খড়ম পিনদিতা বড়তাইন্তে আর ফিতাঅলা চটিখড়ম মহিলা হকলে। তবে ইকানও ঠিক, ই-খড়ম বেশির ভাগ সময়উ ঘরো পিনদা অইতো। মানুষজন হাটবাজার থাকি শুরু করিয়া দূরদূরান্ত এমনকি নয়াপুরানা আত্মীয় স্বজনর বাড়িত যাইতা খালি পাওয়ে। ঘরো হামাইবার আগে দাইরো থওয়া বদনা দি’ পাও ধইয়া ওউ খড়ম পিন্দিতা। আইজ ই-খড়মর জা’গা জুড়ি লাইছে দেশি-বিদেশী প্লাস্টিক আর চমড়ার কতো রঙ-ঢঙর জুতা।

• উক্কা

খড়ম’র লগে লগে আরেকটা জিনিসও আরিযার। ইটার নাম অইলো উক্কা। খড়ম’র লাখান উক্কাও আছিল দুই জাতর। একটা পক্ত নাইকলর আস্তা মালা দিয়া বানাইল অইতো— ইটা আইজ কাইলকুর মোবাইলো লাখান অনেকে আতো লইয়া এক জা’গা থাকি আরেক জা’গাত যাইতা, উক্কা খাইয়া খাইয়া আলচাষ করতা। ই-নাইকল’র উক্কার ব্যবআর আছিল গরিব কিংবা কম রুজিরোজগা’র মাইনষর মাঝে। ধনী বাড়িনতোর পালঙ’র কোনাত আন্নায় টেবুল’র উপরে থাকতো প্লাস্টিকর লাম্বা নলআলা পিতলর উক্কা। গুড়গুড়ি করিয়া বাড়ির বড় হকল’র ইটা টানার মাঝে একটা বড়ত্ব বা আভিজাত্য প্রকাশ পাইতো। যদিও তামাক খাওয়াটা কেউরোর লাগিউ ভালা নায়।

• বটনি

কেরাসিন’র বাত্তি বা লেম থইবার লাগি কাঠ দিয়া বানাইল অইতো লেমদানী বা বটনি। আধা আত থাকি’ একআত উঁচা ইতা বটনি এখন আর চোখুত পড়ে না।

• কুমড়া মিঠা

গাঁউ গেরামো বিয়া শাদির যে ঐতিহ্য আছিল, আস্তে আস্তে ইটার মাঝেও ফাটল ধরা শুরু অইছে। এখন আর আগর লাখান বিয়ার সাপ্তাখানিক আগে থাকি শুরু অয়না বউত আচার অনুষ্ঠান। বাঁশ’র বারিক বারিক কাঁটি দিয়া হারা রাইত কুমড়া ছুকি ছুকি গীত গাইন না মহিলা হকলে। কুমড়া’র ভিত্রে চিনির রস হামাইবার লাগি ই-ছুকা ছুকির কামো কী মজা আছিল, যারা ইতা দেখছইন না, করছইন না তারারে বুঝাইল যাইতো নায়। ইটা খালি আমরার গাঁউগেরামোর ঐতিহ্যউ নায়, ইতা কামো’র মাঝখান দিয়া আমরা একে অন্যর কাছর মানুষে, আপন মানুষে পরিণত অইতাম। মিল মহব্বত, মায়া-মমতা বাড়তো। সুখর ডাক’র আগে দুঃখ’র ডাকো দৌড়াইয়া যাইতাম পারতাম। লাগা বাড়ির চাচির দুঃখরে নিজর দুঃখ মনো করতাম। অখন বিয়া শাদির আগর-ই মজা, হৈ হল্লা নাই। বিয়ার রড়জোর এক সপ্তাহ আগে কার্ড দিয়া আন্নায় মুখে দাওয়াত দেওয়া অয়, অমুক বারে বিয়া, অমুক সেন্টারো। হিকানো হক্কলতা রেডিমেইড। কুমড়া মিঠা বা মুরব্বা যদিও আইজ আর বিয়াত খাওয়ানি অয় না, তবে চাইলে কিংবা খাওয়ানির ইচ্ছা থাকলে ইটাও পাওয়া যাইবো, ইতা লাগি দলবান্ধিয়া, রাইত জাগিয়া মহিলা হকলরে গীত গাওয়া লাগতো নায়। কারণ, এখন অনেক গাঁউ গেরামোও কমিউনিটি সেন্টার অই গেছে। বাড়ির উঠানো আর নানান রঙর কাপড় দিয়া প্যান্ডেল বান্ধা লাগে না।

• নাইয়রীর নাও

ই-তো গেলো বিয়া আর কুমড়া মিঠার কথা। বিয়ার পরে কইন্যা নাইয়র আইতা বেশির ভাগ সময় যে বাহন দিয়া ইটা অইলো নাও। গরিব’র কইন্যা আইতা খালি নাওয়ে আর ধনীর কইন্যা ঘোমটি নাওয়ে। দূরদূরান্ত থাকি মাঝি গলা ছাড়িয়া গান গাইতে গাইতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলিয়া নাও চালাইতা। আইজ ই- জাগাত ভটভটি ইঞ্জিল নৌকা, আন্নায় মাইক্রোবাস, বেবিটেক্সি কিংবা রিকশা।

• পঞ্চাইত

গাঁও গেরামোর সব চেয়ে বড় এবং সমাদৃত ঐতিহ্য পঞ্চাইত বা সালিশ বৈঠক। হুরু থাকি হুরু আর বড় থাকি বড় কাঙ্ক্ষিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানি আন্নায় মীমাংসার লাগি ই-সালিশ বৈঠকর গুরুত্ব কইয়া শেষ করা যাইতো নায়। কতো মানুষ অউ সালিশ বৈঠকের কারণে মামলা মকদ্দমা থাকি রেহাই পাইতা। বর্তমান সরকারর গ্রাম সরকার বানানির চিন্তা অউ পঞ্চাইতী ধ্যান ধারণারউ ফসল। যেটা এক সময় গাঁউর গণ্যমান্য মানুষ হকলে একটা বাড়ির টঙ্গিঘরো জমায়েত অইয়া আঞ্জাম দিলাইতা।

• টঙ্গিঘর

পঞ্চাইতী বা সালিশ বৈঠক’র লগে টঙ্গিঘরোর সম্পর্ক শার্টর লগে গোতাম লাখান আছিল। আইজ টঙ্গিঘরোর লগে লগে সালিশ বৈঠকও যেনো আরিযার। হয়তো অউ কারণে মুরুক মারা, ছাগ্লে গাছ খাওয়া কিংবা গরুয়ে ধান খাওয়া লইয়া মারামারির ঘটনা থানা জজ কোর্ট থাকি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ার।

• আদি-পাটি

গাঁউ গেরামোর বউত বাড়িনতো এখনো যদিও মুত্রা বা বাঁশ বেতর কাজ অয়, তবে ইটা মানিয়া নিতে অয় যে, কুটির শিল্পর ই- ঐতিহ্যটাও আস্তে আস্তে কমিয়ার। মা-চাচি হকলোরে আইজ আর দারিত বইয়া দিনর পর দিন খুয়াইয়া আদি-পাটি বানাইতে খুব একটা দেখা যায় না। তান্তানোর মাঝে অতখানি ধৈর্যও মনোঅয় এখন আর নাই।

• গোপাট

ঐতিহ্যবাহী ই-কুটির শিল্পর লগে লগে গাঁউগেরামো কমিয়া আইয়র গোপাটর সংখ্যা আর ইটার লগে লগে কমের গরুর লাড়াই, মোরগর লাড়াই, ঘোড়া দৌড় কম্পিটিশন। জনপ্রিয়তা আরাইলার পালার গান, যাত্রাগানসহ নানান মৌসুমি মেলা।

• খেউড়

শহর থাকিয়া গাঁও পর্যন্ত কম্পিউটার প্রযুক্তির এই যুগে আকাশ সংস্কৃতির কবলে পড়িয়া আমরা কতো জাতর খেইড় ভুলি যাইরাম। আস্তে আস্তে রূপকথার গল্প অইযার গোল্লাছুট, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, দড়ি ফাল, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, চোর-ডাকাত-পুলিশ, মার্বেল খেইড়, ষোলোঘুটি, চুড়িভাঙা, হাড়িভাঙা, ঘুড্ডি উড়ানি, পুতুলখেইড়, লাটমখেইড়, খালপারো ফিছলাখেইড়, ফটাংমারা, গুলইল বাঁশ মারা, রুমাল চুরি, ঝুমুর ঝুমুর, আগডুম-বাগডুম, ডাংগুলি, ডাংডিং, কুতকুত, এক্কা দোক্কা, চাইরকড়ি, পুতুল বিয়া, লোকালুকি খেইড়, ভিক্ষাখেইড়, লডুখেইড়সহ কতোজাতর, কতো নামর খেইড়। অথচ আমরা চাই না, ইতা সব আরি যাউক। আমরার হাজার বছরর নিজর সংস্কৃতির ভাণ্ডাররে সমৃদ্ধ রাখতে অইলে ইতা খেইড়সহ হক্কলতা বাঁচাইয়া রাখা লাগবো। আর ই-দায়িত্ব যে আমরার হকলর।

 

লেখকঃ কবি ও শেকড় সন্ধানী গবেষক।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: