এম. শহিদুজ্জামান চৌধুরী, (পর্তুগাল):
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি রাজনীতি সহ সমাজ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যেসকল নারীরা
গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, ড. নাজমা চৌধুরী তাদের মধ্যে কিংবদন্তি তুল্য। কীর্তিমান এই নারী আজ ৮ই জানুয়ারি রোজ রবিবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এসময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি নবীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পিটুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইমামুজ্জামান চৌধুরী, মাতা আমিরুন নেছা খাতুন। তাঁর পিতা ইমামুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন, গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। ড. নাজমা চৌধুরী পিতামাতার তৃতীয় সন্তান।
তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় ভারতের আসামে। পরে পিতার কর্মস্থল পরিবর্তনে ঢাকা ও রাজশাহীতে স্থানান্তর হয় তাদের পরিবার। সেজন্য নাজমা চৌধুরীর স্কুল জীবন কেটেছে ঢাকা ও রাজশাহীতে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে অষ্টম স্থান পেয়েছিলেন । পরে হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এসময় মেধা তালিকায় তার অবস্থান ছিলো নবম। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বি এ (অনার্স) এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে গমন করেন পিএইচডি করতে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এর ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান ষ্টাডিজ বিভাগ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং বিভাগে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন বিষয়ক নানা কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার উইমেন ষ্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়। প্রতিষ্ঠার পর তিনি বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অবসরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেন। এছাড়া ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেলগ্রেডে ইউনেস্কো সাধারণ সম্মেলন এবং নাইরোবি ও বেইজিংয়ে বিশ্ব নারী সম্মেলনেও অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। এসময় তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে নারী উন্নয়নের উপর তাঁর লেখা একাধিক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। অধ্যাপক বারবারা নেলসনের সম্পাদনায় আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর লেখা “উইমেন এন্ড পলিটিক্স ওয়ার্ল্ড” গ্রন্থের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি কর্তৃক ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে “ভিক্টোরিয়া চাক” পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে ড. নাজমা চৌধুরী ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মাইনুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাইনুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। তাদের দু’ কন্যা লামিয়া চৌধুরী ও বুশরা হাসিনা চৌধুরী। দুজনই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশ ও জাতির সেবাদানে কর্মরত। মাইনুর রেজা চৌধুরী ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।