তানভীর আহমদ তোহা
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ এবং পবিত্র বাস্তবতা। একাত্তর আমাদের জাতীয় পরিচয়ের এক অবিনাশী পাটাতন। যেই পাটাতন আমাদের ধর্মীয় পরিচয় এবং ভাষা ভিত্তিক পরিচয়ের সাথে বাংলাদেশী হিসাবে একটি অনন্য ” ভৌগোলিক ” পরিচয়ে যুক্ত করেছে। এই বাংলাদেশী পরিচয় আমাদের এই জনপদের মুসলিম, হিন্দু , বৌদ্ব ,খিষ্ট্রান ,বাঙ্গালী ,চাকমা,মারমা, সাওতালসহ সবাইকে এক সুতোয় মালা গেথেছে।
সেই বাংলাদেশী পরিচয়ের পাটাতন নির্মাণ হয়েছে এই জনপদের একেবারেই প্রান্তিক মানুষের রক্তে এবং অকুতোভয় সাহসে ।কোন একক নেতৃত্বের রাজনৈতিক বক্তৃতায় এই পরিচয় নির্মাণ হয় নি। মুক্তিযুদ্বে অংশ নেওয়া সমাজের সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রক্তাক্ত সংগ্রামের বয়ান পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে দিল্লীর প্রেসক্রিপশনে।
বলে নেওয়া ভালো যে , একাত্তর মানে আ’লীগের বয়ান নয় ; একাত্তর মানে শেখ মুজিবের পালিয়ে যাওয়ার সেই কাপরুষোচিত ইতিহাস নয়; একাত্তর মানে শেখ ফজলুল হক মণির মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্বকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্বাদ্বের হত্যা নয়; একাত্তর মানে চাপিয়ে দেওয়া বাহাত্তরের সংবিধান নয়!
একাত্তরের মানে সম্মুখ সমরে শোষণহীন রাষ্ট্র গঠনে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলের আওয়াজ! একাত্তরের মানে মেজর জলিলের মতো সেক্টর কমান্ডারের দিল্লীর প্রতি দাসখত না দিয়েও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে যুদ্ধ করা! একাত্তর মানে শহীদ জিয়ার কালুরঘাটে সেই বীরোচিত স্বাধীনতার ঘোষণা ! একাত্তর মানে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর ” পাকিস্তানকে ” আস্সালামালাইকুম বলা ! একাত্তর মানে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেক্টর কমান্ডারসহ সকল দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তাদের জীবন বাজির এক দু:সাহসিক খেলা!
সেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের পর এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। স্বাধীনতার অমূল্য স্মারক একাত্তরের দোহাই দিয়ে বারবার এদেশের মানুষের স্বাধীনতাকেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো ! গনতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জন্য সংগঠিত হওয়া মুক্তিযুদ্বকে স্বাধীনতা পাওয়ার কিছু দিন পরই বাকশাল তৈরী করে মুক্তিযুদ্ধের উপর চুড়ান্ত আঘাত দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আকাঙ্ক্ষার উপর আঘাত আসার পরই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্বা দ্বারা পচাত্তরে সফল সামরিক অভূত্তানের পর বাংলাদেশ ধীরে- লয়ে মুক্তিযুদ্বের মৌল আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ গনতন্ত্রের পথে হাটতে শুরু করে। নানা চড়া-উৎরাই পেরিয়ে চলা বাংলাদেশের গনতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার আবারও ২০০৯সালে ভয়াবহভাবে ভারতীয় আধিপত্য এবং পচাত্তরের পরাজিত মুজিববাদের কাছে ” আয়নাঘরে ” বন্ধি হয়ে গিয়েছিলো । বিগত ১৫ বছর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই জনপদের মানুষ মুজিববাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে শুধুমাত্র নিজেদের জবানের স্বাধীনতা হারায়নি ;হারিয়েছিলো নিজের জানের নিরাপত্তাও।
বিগত পনেরো বছরে হাসিনা নেতৃতাধীন ফ্যাসিস্ট শাসনের নজিরবিহীন নিপীড়ন ও নির্যাতনে এদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো যখন নখদন্তহীন বাঘে পরিনত হয়ে শুধুমাত্র ঠিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলো ঠিক সেই সময়ে ” আবাবিল পাখির ” মতো হঠাৎ করে এদেশের সাহসী সন্তানেরা একাত্তরের মতোই আবারও নিজেদের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে আগষ্ট মাসে এক মহা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে মুজিববাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে।
একাত্তর এবং চব্বিশের বিপ্লবের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রার্থক্য হলো একাত্তরের যোদ্ধারা অস্র হাতে নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে ঘর থেকে বের হয়েছিলো অপরদিক চব্বিশ বিপ্লবের যোদ্ধারা অস্র ছাড়াই শুধুমাত্র বুকভর্তি দেশপ্রেম নিয়ে খালি হাতেই ঘর থেকে বের হয়েছিলো এদেশীয় ভারতপন্থী অস্রসজ্জিত দখলদারদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য! একাত্তরে মুক্তিযোদ্বারা পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের মারতে মারতে এবং নিজরা শত্রুদের হাতে শহীদ হয়ে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় এনেছিলো।অন্যদিকে , চব্বিশের যোদ্বারা মুজিববাদী সন্ত্রাসী এবং এদেশীয় ভারতপন্থী দখলদারদের হাতে নিজেরা শুধু মরতে মরতে ৫ আগষ্টে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। একাত্তর আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা দিয়েছিলো অপরদিকে চব্বিশের বিপ্লব আমাদের দিয়েছে জান ও জবানের স্বাধীনতা। চব্বিশের বিপ্লব বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের তার শত্রুদের চিনিয়ে দিয়েছে ঝর্নার পানির মতো সচ্ছ ভাবধারায়। চব্বিশের বিপ্লব আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ইসলামপন্থী থেকে সমাজতন্ত্রী সব মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি কিভাবে জাতীয় ঐক্যের অক্ষ রেখার নিজেদের নিয়ে চালিত করতে পারে। ভৌগোলিক স্বাধীনতা এনে দেওয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ব আমাদের অস্তিত্বের পাঠাতন সৃষ্টি করলেও চব্বিশের বিপ্লব বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ” আলোকবর্তিকা” হয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আকাশে নতুন সূর্য হিসাবে উদিত হয়েছে।মুক্তিযুদ্ব যেমন আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখার প্রশ্নকে মীমাংসিত করে দিয়েছে ঠিক তেমনি চব্বিশের বিপ্লব বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আগামীদিনের চলার নীতি অর্থাৎ মুজিববাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকে মীমাংসিত করে দিয়েছে। সুতরাং ; মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত হওয়ার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূমি যতদিন প্রর্যন্ত চব্বিশের বিপ্লবকে ” আলোকবর্তিকা” হিসাবে ধারন করে চলবে ততোদিন প্রর্যন্ত বাংলাদেশ তার গনতান্ত্রিক এবং বহুত্ববাদী সমাজের এক অনন্য চেহারা নিয়ে সমকালীন ও ভবিষ্যত দুনিয়ায় মাথা উচু করে ঠিকে থাকতে পারবে বলে বাংলাদেশ প্রেমী মানুষজন মনে করেন।
লেখক: এক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট