মোহাম্মদ আব্দুল হক
জিয়া কিংবা জিয়াউর রহমান নামের মানুষ বাংলাদেশে অনেক অনেক আছে এবং থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় মোটেই। কিন্তু এক-ই সাথে সৈনিক, একটি দেশের সেনাবাহিনী প্রধান, একটি সুনির্দিষ্ট বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের মুক্তি সংগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর প্রথম দিকেই চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মুক্তি সংগ্রামের যোদ্ধাদেরকে অনুপ্রেরণা প্রদানকারী, রাজনীতিক, রাষ্ট্রনায়ক, কোটি কোটি বাঙালি জনতার জিয়া হিসেবে পরিচিত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এবং সারা দুনিয়ায় একজনই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান নামটি গুরুত্ব নিয়ে উচ্চারিত হয়। এখানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি সৈনিক জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কিছু কথা স্মরণ করছি।
ব্রিটিশ-ভারতের শাসন আমলের শেষ দশক এবং ভারত ভাগের পরে পাকিস্তান আমলের দুঃশাসন ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদেরকে শোষণ কিভাবে করা হয়েছে তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করা একজন সাহসী যোদ্ধা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলার সুযোগ এখানে নেই, কারণ, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে এক মহাকাব্যের নায়ক হয়ে ফুটে আছেন দেশে ও বিদেশে। জন্ম নেয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সারা জীবন নিয়ে পূর্ণ রূপে উপস্থাপন করতে হলে বিশাল এক গ্রন্থ রচনা করলেও অপূর্ণ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যাবে। কাজেই বাংলাদেশের একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের কথা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে বলবো।
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ খ্রীষ্টিয় সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম ছিলো কমল। তাঁর পিতার নাম মনসুর রহমান এবং মায়ের নাম জাহানারা খাতুন ( রাণী)। তাঁর পিতা তৎকালীন বৃটিশ ভারতের কলকাতা শহরের এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জিয়াউর রহমানের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর শৈশবের প্রথম দিকে কিছুটা কাল কেটেছে বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতার নগর জীবনে। তাঁর পিতা চাকরি করতেন, তাই তিনিও পিতার সাথে থাকতেন এবং সেখানে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তখন কলকাতার হেয়ার স্কুলে তিনি পড়াশোনা করতেন। কিন্তু তৎকালীন বৃটিশ – ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নানানরকম ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ খ্রীষ্টিয় সালের দেশ বিভাগের পরে অর্থাৎ ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান দুই নামে দুটি পৃথক দেশ হিসেবে ভাগ হওয়ার পরে তাঁর পিতা কলকাতা শহর ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী নগরীতে চলে যান এবং সেখানেই জিয়াউর রহমান করাচী একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। জানা যায়, ওই করাচী একাডেমি স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫২ খ্রীষ্টিয় সালে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর তিনি কলেজে ভর্তি হন ১৯৫৩ খ্রীষ্টিয় সালে করাচীর ডি.জে. কলেজে। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত সাহসী ও মেধাবী ছিলেন। একই বছর তিনি পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে চাকরিতে যোগ দান করেন। তিনি তাঁর মনোযোগ কাজে লাগিয়ে দক্ষতা দেখিয়ে ১৯৫৫ খ্রীষ্টিয় সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। দেখা যায় জিয়াউর রহমান প্রথম থেকেই সকল ক্ষেত্রে তাঁর মেধা খাটিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন এবং দক্ষতা দ্বারা সুনাম অর্জন করে এগিয়েছেন বীরের বেশে। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীতে একজন বিচক্ষণ প্যারাট্রুপার এবং কমান্ডো। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর দক্ষতা দেখিয়ে অল্প সময়ে সেনাবাহিনীর অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের মাঝে সুপরিচিত একজন হয়ে উঠেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে ভর্তি হন এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সামনে এগিয়ে চলার পথ তৈরি করেন। জিয়াউর রহমান এভাবে দুই বছর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে সুনাম ও সাহসিকতা দুটোর সংমিশ্রণে চাকরি করেন। এখানে উল্লেখ করছি, স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠা বাংলার সন্তানদের কাছে হয়তো প্রশ্ন জাগ্রত হতে পারে, বারবার কেন পশ্চিম পাকিস্তানকে ঘিরে কথা হচ্ছে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। প্রকৃত অর্থে আমরা তখন পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক। এমনকি ১৯৭০ খ্রীষ্টিয় সালের সাধারণ নির্বাচন-ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছিলো যেখানে আমরা বাঙালিরা আমাদের তৎকালীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিপুল ভোটে বিপুল আসনে জয়ী হয়েছিলাম। এ বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের ইতিহাস পড়তে হবে। সে যা-ই হোক, আমরা জানি দেশপ্রেমিক সৈনিকের জীবন থেমে থাকার নয়। এরপর তিনি ১৯৫৭ খ্রীষ্টিয় সালে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। প্রতি ধাপে শিখতে শিখতে এগিয়েছেন এবং ক্লান্তি তাঁকে স্পর্শ করেনি। আমরা দেখি, ১৯৫৯ খ্রীষ্টিয় সাল থেকে ১৯৬৪ খ্রীষ্টিয় সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগেও কাজ করেছেন। এভাবেই একজন বীর বাঙালি সৈনিক জাতির প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্যে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে এবং সৈনিকের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে অংশ গ্রহণ করে সফলতা নিয়ে ফিরেছেন। ইতিহাসের খোঁজে পাওয়া যায়, ১৯৬৫ খ্রীষ্টিয় সালের ভারত ও পাকিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা। তৎকালীন ঐতিহাসিক ওই যুদ্ধে বাঙালির রক্তে মাংসে গড়া আমাদের জিয়াউর রহমান একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে তাঁর জীবনের অসীম সাহস নিয়ে খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। ওই যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। এ গৌরব বাঙালি সৈনিকের।
এই নিবন্ধে একজন জিয়াউর রহমান সম্পর্কে লেখা মূলত সময়ে একজন বাঙালি সৈনিকের সাহসী ভূমিকাকে স্মরণ করা, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিচক্ষণতার প্রমাণ দেয়া একজন মুক্তিযোদ্ধাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বরণ করা, বাংলাদেশের একজন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করা। একজন বীর সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক নেতা হঠাৎ এসেই কোটি কোটি বাঙালির প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেননি। কোনো বিশেষ মানুষকে মানুষের ভালোবাসার মানুষ হিসেবে হয়ে উঠার পিছনে থাকে সাহস, কর্তব্যের প্রতি একনিষ্ঠতা, সততা, দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এসব গুণাবলী একজন মানুষকে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের আপন মানুষ হতে সাহায্য করে। জিয়াউর রহমানের মধ্যে মানুষের মন জয় করে গণমানুষের নেতা হয়ে উঠার গুণাবলী ছিলো। এজন্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মাঝে তিনি অতি আপনজন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। এবার আমরা আরেকটু এগিয়ে দেখি, ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের পর হিলাল-ই-জুরাত খেতাব পাওয়ার পর জিয়াউর রহমান ১৯৬৯ খ্রীষ্টিয় সালে সেনাবাহিনীর মেজর পদে উন্নিত হন। জিয়াউর রহমান জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন – কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর তিনি নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অ্যাডভান্সড মিলিটারি অ্যান্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে পশ্চিম জার্মানিতে গিয়েছিলেন এবং কয়েক মাস বৃটিশ আর্মির সঙ্গেও কাজ করেন। বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে জিয়াউর রহমান ১৯৭০ খ্রীষ্টিয় সালে একজন মেজর হিসেবে দেশে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে নব গঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড – ইন কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের এক ভয়াবহ যুদ্ধ স্মরণীয়। এখানেও সেই বীর যোদ্ধার বীরত্বের পরিচয় পেয়েছে বাঙালি। ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার বুকে ভারী অস্ত্র নিয়ে আক্রমন করে নির্বিচারে গুলি চালায় ও মানুষ মারে, তখন জিয়াউর রহমান দেশ ও বাঙালির টানে চট্টগ্রামে থাকাকালীন তাঁর সিনিয়র অফিসার পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দী করেন এবং বিদ্রোহ করেন। তৎকালীন সময়ে শক্তিশালী পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে এমন দুঃসাহসিক অভিযান কেবল দেশমাতৃকার জন্যে এবং দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে সম্ভব। জিয়াউর রহমান সেই সাহসী কাজটি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী তখনও নেতাহীন বাঙালি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারেনি। অনেকটা দিশাহারা বাঙালি জাতি তাদের নেতা বিহীন। তখন ২৭ মার্চ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে একজন বাঙালি আর্মি অফিসারের এক সাহসী কন্ঠের ঘোষণা শুনতে পেয়ে মানুষ দারুন সাহসী হয়ে উঠে। হ্যাঁ, তখন মেজর জিয়াউর রহমানের কন্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বারবার প্রচার করা হয়। মূলত এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জেনে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে দেখি রাজনৈতিক দলীয় প্রতিপক্ষেরা স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে সহজ ভাবে মেনে নিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু ; যিনি ঘোষণা করেন বা কোনো বিবৃতি কোনো প্রচার মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করেন তাঁকে ঘোষক বলতে বাধা কোথায় আমি বুঝি না। রাজনৈতিক নানান কথার মারপ্যাঁচ আমি বুঝি না। সে যা-ই হোক, এরপরই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। বাংলার গৌরব সন্তান সিলেটের বীর সন্তান জেনারেল এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে মোট এগারোটি সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ চলে এবং প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণের বিনিময়ে ও প্রায় দুই লক্ষ বাঙালি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের অধিনায়ক। জিয়াউর রহমান সময়ের সাহসী সন্তান। যখনই দুর্যোগের ঘনঘটা তখনই জিয়াউর রহমান উপস্থিত হয়েছেন বুদ্ধি ও সাহসে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্যে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। আমরা পাই মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এবং সেই সাথে সব সময় জানাই তাঁকে সহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে,স্যালুট।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকে নানান অস্থিরতা দেশজুড়ে। ‘এখানে রাজনৈতিক টানাটানির নানান ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ এর সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হলো। কিন্তু ১৯৭৩ এর মার্চেই সংবিধান সংশোধন হলো। ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারী দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ বন্ধ হয়ে গেল এবং এ বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলো।’ তখন আমাদের দেশের সেনাপ্রধান ছিলেন শফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক। এরপর একের পর এক পরিবর্তন। তৎকালীন ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব আবারও জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জিয়াউর রহমান এক সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদ নিয়ে এলোমেলো পরিস্থিতি। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না, দেশ অরক্ষিত বিবেচিত হয়। এমন দুঃসময়েও এগিয়ে এলেন জিয়াউর রহমান। মাঝে রাজনীতি ও সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার পর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে গণতান্ত্রিক-ঐক্যজোট এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি, ন্যাপ ( মোজাফফর) সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে জেনারেল অবঃ মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সহ আরো কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তখন জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই থেকে তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এরপর ১৯৭৯ খ্রীষ্টিয় সালে দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চার পাশাপাশি নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম চলছিলো গ্রাম থেকে শহরে। বিদেশেও যোগাযোগ বাড়িয়ে সুনাম অর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছিলো বাংলাদেশ।
জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক সুবিধা জনক পরিবর্তন এসেছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শুধু বাঙালি নয়, বরং ; বাঙালি – অবাঙালি সকল জাতিগোষ্ঠীর চিন্তা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এসেছে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের শুধু ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয় থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আমেরিকা, চীন সহ সর্বত্র ছড়িয়ে, ব্যাপক ভাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিস্তারিত এখানে আলোচনার সুযোগ নাই। তবে ; দেশ ভালো-ই চলছিলো। ‘কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ১৯৮১ খ্রীষ্টিয় সালের ৩০ মে বেতার ( রেডিও) ও টেলিভিশনে তৎকালীন সেনাপ্রধান লে জে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে।’ শেষ করছি আমার লেখা ‘গণতান্ত্রিক প্রেম’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কথা উল্লেখ করে – “বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি কোনোদিন সরাসরি দেখিনি। তবে ইতিহাস পড়ে জেনেছি তিনি ছিলেন অনেক বড়ো মাপের একজন মানুষ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা আমি নিজের চোখে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো এর কিছুদিন পরেই। সারা পৃথিবী জানলো এক বীরের মৃত্যু সংবাদ।
সেদিন ৩০ মে যখন শুনতে পেলাম, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী অফিসার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে গুলি করে মেরে ফেলেছে, সেই দুঃসংবাদ শোনার পরে আমার শিশু মনে প্রচন্ড ধাক্কা লেগেছে। শুধু তা-ই নয়, আমি বিস্ময়ে দেখেছি, সেদিন কতো মানুষকে দেখেছি কান্নাকাটি করতে করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। সেই দিনের ঘটনা ঘটার পরে বুঝতে পেরেছিলাম , বাংলাদেশের একজন বড়ো মাপের নেতাকে মেরে ফেলেছে। মানুষ তাঁকে খুব ভালোবাসতো।” শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনতার জিয়া ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ খ্রীষ্টিয় সাল থেকে ৩০ মে ১৯৮১ খ্রীষ্টিয় সালের আয়ুষ্কাল নিয়ে ইহকালে অর্জন করেছেন সুনাম সুখ্যাতি এবং মরেও বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে। সেই থেকে বাংলাদেশের মানুষ ৩০ মে দিবসকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে এক-ই সাথে তাঁর পরিবার ও তাঁর গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি তাৎক্ষণিক বড়ো ধাক্কা খায়। একান্ত আপন পারিবারিক জীবনে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ খ্রীষ্টিয় সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হলে, তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে রেখে যান, দুই ছেলে তখন ছোটো ছিলো। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে সাথে সাথেই বেগম খালেদা জিয়াও দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি বা তখনও তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েননি। পরবর্তীতে বিচারপতি আবদুস সাত্তার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হয়ে ১৯৮১ খ্রীষ্টিয় সালের ১৫ নভেম্বরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এখানে অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে তৎকালীন সেনা প্রধান হো মো এরশাদ সামরিক শক্তি দিয়ে দেশের ক্ষমতা দখলে নেন। এরপর সময়ের প্রয়োজনে দলীয় নেতাকর্মীদের পরামর্শে বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে ১৯৯১ খ্রীষ্টিয় সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৪০টি আসন জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং সংসদীয় সরকার গঠন করে। বেগম খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এরপর আবারও ২০০১ খ্রীষ্টিয় সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৩০০টি আসনের ১৯৩টি আসনে জয়ী হয় এবং বেগম খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতাসীন হন। পরবর্তীকালে নানান রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপ ও বহু রকম ভাবে জনগণ-মনের থেকে দলটি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে ; এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
লেখক: কলামিস্ট ও সাহিত্যিক