শার্লত বোয়াতিও:
ফ্রান্সে আশ্রয় আবেদন করা একজন আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন যখন শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীনদের জন্য নির্ধারিত ফরাসি দপ্তর অফপ্রা থেকে নাকচ হয়, তখন তিনি চাইলে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফরাসি জাতীয় আশ্রয় আদালতে (সিএনডিএ) আপিল করতে পারবেন। বাংলা টেলিগ্রামের পাঠকদের জন্য আপিল পরবর্তী শুনানি ও আইনি সহায়তার খুঁটিনাটি ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এখানে তুলে ধরা হলো।
শরণার্থী এবং রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত ফরাসি দপ্তর (অফপ্রা) থেকে প্রথম পর্যায়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের ফরাসি জাতীয় আশ্রয় আদালত সিএনডিএ তে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। অর্থ্যাৎ আশ্রয়ের অধিকারের জন্য জাতীয় আদালতে আবারও আশ্রয় আবেদনটি পুর্নবিবেচনার জন্য আবেদন করা।
কিন্তু প্রায়শই আপিলের আইনি পরিভাষা ও প্রশাসনিক পদ্ধতিগুলি বেশ জটিল হয়ে থাকে। আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য আপিলের সব বিষয়গুলোকে একীভূত করা বেশ কঠিন। সিএনডিএতে আপিল আবেদনের পরে আদালতে বিভিন্ন ধরনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আলোচনায় থাকা এসব ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাঠকদের জন্য ব্যাখ্যা করা হলো:
‘অরদোনোন্স’ বা স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান
সিএনডিএ থেকে কোনো প্রকার শুনানিতে উপস্থিত হওয়া ছাড়াই যদি কোন আশ্রয়প্রার্থী তার আপিল আবেদনের সিদ্ধান্ত পেয়ে যান সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে আবেদনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ‘অরদোনোন্স’ দ্বারা রায় দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ আবেদনকারীকে শুনানিতে স্বশরীরে না ডেকে মামলার দায়িত্বে থাকা বিচারক আপিলের পুরো ফাইলটি পড়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আদালতে স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান আদেশ দেয়ার আগে কোনো ব্যক্তিকে তলব করার প্রয়োজন মনে করে না। এমনকি আপিল আবেদনকারী ও তার আইনজীবীর কোন বক্তব্যও শোনা হয় না।
সাধারণত, অফপ্রা থেকে নাকচ হওয়া আবেদনটিতে যদি উল্লেখযোগ্য কোন গুরুতর উপাদান, যুক্তি কিংবা প্রমাণ অন্তর্ভুক্ত করা না হয় সেক্ষত্রে সিএনডিএ ‘অরদোনোন্স’ বা স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান জারি করে থাকে ।
এ ব্যাপারে ইনফোমাইগ্রেন্টস বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানান, অরদোনোন্সের মাধ্যমে দেয়া সিদ্ধান্তগুলির প্রায় সবগুলো আদেশই প্রত্যাখ্যান হয়ে থাকে। অর্থাৎ আবেদনকারীর আশ্রয় আবেদনটি আদালতেও বাতিল বলে গণ্য হবে।
২০২১ সালে বহু বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের আশ্রয় আবেদন সিএনডিএ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। গণহারে অরদোনোন্স জারির প্রতিবাদে ধর্মঘট ও কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন আশ্রয় আদালতের আইনজীবীরা।
আদালতে গণশুনানিতে ডাকা হলে:
কোন আশ্রয়প্রার্থী তার আপিল আবেদন জমা দেয়ার পরে সিএনডিএ থেকে প্রাপ্ত চিঠিতে যদি গণশুনানি বা পাবলিক অডিয়েন্সে উপস্থিত হওয়ার চিঠি পান সেক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে আপিলের সময় উল্লেখ করা বিষয়গুলি নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে আদালতের সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। গণশুনানি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। এক্ষেত্রে যেকোন নাগরিক, এনজিও বা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকার অধিকার রাখেন।
গণশুনানিতে সাধারনত একজন আবেদনকারীকে এক বা একাধিক বিচারকের সামনে তলব করা হয়। শুনানিতে একজন আশ্রয়প্রার্থী আদালতের প্রশ্নের উত্তরে যুক্তি দিয়ে নিজের সমস্যা তুলে ধরার সুযোগ থাকে।
শুনানির অধিবেশনটি সাধারনত সিএনডিএ ভবনের বিভিন্ন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। একটি শুনানির শুরুতেই বিচারকরা আবেদনকারীকে কোন প্রশ্ন করেন না। তারা প্রথমে রাপোর্টার এর কাছে থেকে মামলার বিস্তারিত শুনবেন। পরবর্তীতে আদালত আশ্রয়প্রার্থীকে ফরাসি ভাষায় বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করেন। আদালতের বক্তব্য অনুবাদের জন্য আশ্রয়প্রার্থীর মাতৃভাষা ও ফরাসি বলতে পারেন এরকম একজন দোভাষী থাকেন। পাশাপাশি আবেদনকারীর আইনজীবীও শুনানিতে উপস্থিত থাকেন।
উল্লেখ্য প্রথম অবস্থায় মামলার বিবরণ বর্ণনাকারী ‘রিপোর্টার’ একজন সিএনডিএ এজেন্ট যিনি আপিল আবেদন যাচাই বাছাই করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। তিনি ফাইলের নথিগুলি বিশ্লেষণ করেন, ঘটনাগুলির আইনি উপাদান, ভূ-রাজনৈতিক বিবরণ পরীক্ষা করেন। তার দায়িত্ব কোন পক্ষ না নিয়ে বিতর্কগুলিতে আলোকপাত করা এবং সেগুলি আদালতে উপস্থাপন করা। তিনি কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, আদেশ বা রায় প্রদান করেন না।
একাধিক বিচারকের সামনে শুনানিতে ডাকা হলে:
সিএনডিএ বেশীরভাগ শুনানিতে সাধারনত একাধিক বিচারক উপস্থিত থাকেন। এক্ষেত্রে তিনজন বিচারক আশ্রয়প্রার্থীর বক্তব্য শুনে থাকেন। শুনানি ও আইনজীবীর যুক্তিতর্ক শুনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রায় দেয় বিচারকেরা।
একাধিক বিচারকের ক্ষেত্রে উপস্থিত তিন বিচারক প্যানেলই সরাসরি আশ্রয়প্রার্থীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকেন।
অফপ্রার দেয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে একজন আশ্রয়প্রার্থীকে এখানে আবারো তার সব সমস্যা বিশদভাবে বলতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিচারকের প্যানেলে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে একজনপ্রধান মূল্যায়নকারী থাকেন সিএনডিএ এর স্থায়ী বিচারক। দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে একজন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধি থাকেন। এছাড়া ফরাসি বিচার বিভাগে কনসেই দেতা বা কাউন্সিল অফ স্টেটের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত একজন প্রতিনিধি থাকেন যিনি তৃতীয় মূল্যায়নকারী বিচারক হিসেবে প্যানেলে নিযুক্ত থাকেন।
একক বিচারকের সামনে শুনানি তে ডাকা হলে:
সিএনডিএ সাক্ষাৎকারে কোনো আশ্রয়প্রার্থীকে ডাকা হলে অনেক সময় সাক্ষাৎকারের আমন্ত্রণপত্রে একক বিচারককে সামনে শুনানিতে উপস্থিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা থাকে। এটির অর্থ হচ্ছে একজন আশ্রয়প্রার্থীর সাক্ষাৎকার, যুক্তিতর্ক এবং আইনজীবীর বক্তব্য শুনে একজন মাত্র বিচারক রায় প্রদান করবেন। তবে বরাবরের মতো আশ্রয়প্রার্থীর সাথে তার আইনজীবী এবং একজন দোভাষী উপস্থিত থাকতে পারবেন।
সাধারনত যেসব আপিল আবেদন আদালতের বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ সেসব আবেদনকে ত্বরিত পদ্ধতিতে শেষ করতে একক বিচারকের অধীনে রায় দেয়ার জন্য আলাদা করা হয়।
এই পদ্ধতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে আশ্রয় আদালতের আইনজীবীরা এটি নিয়ে অনেক দিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার :
অফপ্রাতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একজন ব্যক্তি যখন ফরাসি জাতীয় আশ্রয় আদালতে আপিলের প্রস্তুতি নেন তখন আইনি সহায়তার কথা প্রায়শই শোনা যায়। ফ্রান্সে অবস্থানরত সকল নিম্নআয়ের লোকদের রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদত্ত অর্থের মাধ্যমে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আইনজীবীর ফির উপর এটি নির্ভর করবে উনি সমপরিমাণ সরকারি অর্থ দিয়ে কোনো আশ্রয়প্রার্থীর মামলা লড়বেন কিনা।
আইনি সহায়তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মঞ্জুর করা হয় না। আদালতে আপিলের পূর্বেই এটি পেতে আবেদন করতে হয়।