প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গে
মোহাম্মদ আব্দুল হক
ফিলিস্তিন ও ইজরায়িল বা প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল প্রসঙ্গ, যুগ যুগ ধরে মুসলমান ও ইহুদির মধ্যে সংঘাতময় প্রসঙ্গ, যা বিশ্বের ধর্মীয় আলোচনা ও রাজনীতিতে অতি মাত্রায় প্রভাব ফেলে চলেছে। যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল, মুসলিম, ইহুদি ও আল-আকসা মসজিদ নিয়ে আলোচনা চলমান শত বছর ধরে, কিন্তু দুঃখ জনক হলো এখানে মুসলিম দেশ সমূহ আল-আকসা বা প্যালেস্টাইন নিয়ে মুসলিমদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতে দেখা যায় না।
প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, আজকে ইসরায়েল, আমেরিকা, ফ্রান্স, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, জার্মান, ইন্ডিয়া ইত্যাদি ইহুদি বা খ্রিস্টান নেতৃত্বের দেশ সমূহ আধুনিক প্রযুক্তিতে শক্তিশালী, চিকিৎসা গবেষণায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে এগিয়ে গেছে , লেখাপড়ায় ও জ্ঞান অর্জনে সকলকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর মুসলিম ধনী দেশগুলো উঁচু ভবন বানানো আর বিলাসিতায় ব্যস্ত। আর গরীব দেশের মুসলমানরা শুধু বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেই অধিক মনোযোগী। এদের পক্ষেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কুটনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণাগার গড়ার অথবা সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার জন্যে বিশ্বমানের পাঠাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। সেজন্যে বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো মুসলিম দেশের টিকা বা ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সফলতা নাই। অথচ ইসলাম ধর্ম হচ্ছে জ্ঞান ভান্ডার, এই ধর্ম শুধু বিলাসিতা করার ভান্ডার নয়। ইসলামের নবী হযরত মুহম্মদ সাঃ এর কাছে পড়া ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সর্বাধিক। বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির মার খেয়ে রাস্তায় জড়ো হয়ে কয়েকটি প্রতিবাদ করলেই সফলতা আসবে না। চাই জ্ঞান সাধনা, ধ্যান এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিজয় অর্জন করা এবং বিজয় ধরে রাখা। গরীব দেশের মেধাবী ছেলে মেয়ে গবেষক হচ্ছে, কিন্তু গবেষণার জন্যে গবেষণাগার নাই, তাই সে চলে যাচ্ছে আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া, ইসরায়েল, চীন ইত্যাদি দেশে। ভাবতে হবে।
এখানে মানুষের ধর্মমতের ব্যাপক আলোচনা মূখ্য নয়। এখানে দুনিয়ায় বহুল চর্চিত ধর্মের অনুসারী দেখি। এখানে বিরোধটা কোথায়?
এখানে যারা ইসলাম ধর্ম মতানুসারী, তাদের কাছে নবী ইব্রাহিম আঃ , নবী মুসা আঃ , নবী ঈশা আঃ এবং শেষ নবী বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ সাঃ সহ সকল নবী ও রাসূলগণ সম্মানিত। তাই ইসলাম ধর্ম মতানুসারীদের নিকট তাদের ধর্ম পালন ও জীবনানন্দের প্রতি ক্ষেত্রে সকল নবী ও রাসূলদের গুরুত্ব সর্বাধিক। ইসলাম অনুসারী অর্থাৎ মুসলিমগণ তাদের ধর্ম পালনে পূণ্য লাভের আশায় সকল নবী ও রাসূলগণের শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপনের নির্দেশনা পেয়ে থাকে।
এখানে যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাদের কাছে তাদের ধর্ম পালন ও জীবনানন্দে ইসলামের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রেরিত নবী ও রাসূলদের গুরুত্ব নেই। হিন্দু ধর্মানুসারীগণ তাদের হাজার হাজার বছরের লালিত বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন অবতারের প্রচারিত আচার নিয়ে আছেন এবং বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্ত প্রতীক বানিয়ে তাদের পূজা করে পূণ্য পাওয়ার আকাঙ্খা করেন। হ্যাঁ, ইসলাম মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে। কিন্তু হিন্দুদের ধর্ম পালনে বাধা দেয়ার শিক্ষা ইসলাম ধর্ম দেয়নি।
এখানে যারা বৌদ্ধ ধর্ম মতানুসারী, তারা গৌতম বুদ্ধ থেকে জ্ঞান পেয়ে সে বিশ্বাস নিয়ে ধর্ম পালন করে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ একজন তপস্বী জ্ঞানী। তাদের কাছে ইসলামের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় আশা নবী ও রাসূলগণ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত নয়। হ্যাঁ, এখানেও মূর্তি প্রাধান্য পায় ; তবে ইসলামের শিক্ষায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর হামলা করা বা তাদের ধর্ম পালনে বাধা দেয়ার নির্দেশ নাই।
এখানে যারা ইহুদি ; তারা নবী ইব্রাহিম আঃ কে অস্বীকার করে না। ইহুদিরা নবী মুসা আঃ কে অস্বীকার করে না। তারা মুসা আঃ কে বলে মুজেস। এপর্যন্ত ধারাবাহিকতা ইহুদিরা পেয়ে এসেছে। এখানেই তারা থেমেছে। তারা ধর্মীয় পূর্ণতার দিকে আর এগোয়নি। ইহুদিরা মূলত বনী-ইস্রায়েল জাতির অন্তর্গত ইহুদি ধর্মের অনুসারী জনগোষ্ঠী। ইব্রাহীম আঃ এর পুত্র ইসহাক আঃ ও তাঁর পুত্র ইয়াকুব ওরফে ইসরাইল আঃ এর বংশধরগণ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত। ইয়াকুব আঃ এর বারো পুত্রের নামে বনী-ইস্রায়েলের বারোটি গোষ্ঠীর জন্ম হয় যার মধ্যে ইয়াহুদা’র ছেলেমেয়েরা ইহুদি নামে পরিচিত। এই ইহুদি সম্প্রদায়কে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট সয়েছেন নবী হযরত মুসা আঃ। এদের উপর আল্লাহর রহমত এসেছে এবং এদের কুকর্মের জন্যে এদের উপর শাস্তিও এসেছে।
এখানে যারা খ্রিস্টান অর্থাৎ নবী ঈশা আঃ অনুসারী ; তারা নবী ইব্রাহিম আঃ কে ও নবী মুসা আঃ কে অস্বীকার করে নয় ; বরং নবী ইব্রাহিম আঃ থেকে ধারাবাহিকতায় ঈশা আঃ পর্যন্ত আদেশ পেয়েছে। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপর একবারেই সবকিছু চাপিয়ে দেননি। মানুষের জন্যে পূর্ণাঙ্গ উত্তম জীবনাচার এসেছে ধারাবাহিক ভাবে। কিন্তু খ্রিস্টান সম্প্রদায় আর এগোয়নি, তারা নবী ঈশা আঃ এ আটকে যায়। তারা ঈশা আঃ কে বলে যীশু। তারা তাদের ধর্ম গ্রন্থ পরবর্তী সময়ে নিজের মতো করে সংস্কার করে নিয়েছে। ইসলামে নবী হযরত ঈশা আঃ কে মসীহ বলা হয়ে থাকে।
এখানে ইহুদিরা যাঁকে মানছে, মুসলিমগণ তাঁকে নবী মুসা আঃ হিসেবে সম্মান প্রদর্শন করেই ইসলাম ধর্ম অনুসারী মুসলমান। এখানে দেখা যায় খ্রিস্টানরা যাঁকে মানছে, বিশ্ব মুসলিমগণ তাঁকে নবী ঈশা আঃ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সম্মান প্রদর্শন করে এবং বিশ্বাস করেই বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ সাঃ এর উম্মত এবং মহান আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মানুষের জন্যে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান পবিত্র কোরআন এর শিক্ষা নিয়েই মুসলমান।
এখানে দেখা যায়, ইহুদিরা পরবর্তীতে ঈশা আঃ কে মানছে না ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় নবী ঈশা আঃ পরবর্তী সময়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও রাসূল হিসেবে হযরত মুহম্মদ সাঃ কে আর মানছে না। আশাকরি এপর্যন্ত পড়ে আমরা সংক্ষিপ্ত ধারণা পেয়েছি, কেন পরবর্তী বিশ্ব ইতিহাসে খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদিদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধ। এখানে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি, কেন ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ সাঃ এর অনুসারী বা উম্মতের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মেনে নিতে পারে না।
ইসলাম ধর্ম মতানুসারীদের মাঝে অন্য ধর্মের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। কারণ, এখানে মুসলমানরা পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা। মুসলমানগণ পেয়েছে ধৈর্যের শিক্ষা। হ্যাঁ, মুসলমানগণ জানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসবে। শেষ পর্যন্ত ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে এবং মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা ও রাসূল হযরত মুহম্মদ সাঃ এর অনুসারীদের বিজয় হবে। কিন্তু কোরআন ও হাদিসের মতো সমৃদ্ধ জ্ঞান পেয়েও উদাসীন থাকলে আমাদেরকে-তো অপদস্ত ও অপমানিত হয়ে দুনিয়ায় চলতে হবেই। এখানে ইসলাম ধর্মের দুর্বলতা নয় ; এ হচ্ছে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের দায়। হ্যাঁ, আল্লাহর হুকুমে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগে পবিত্র কোরআনে যেসকল ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে এবং মহানবী হযরত মুহম্মদ সাঃ যা বলে গেছেন তার সবকিছুই ঘটবে। ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে, মহান স্রষ্টা ইহকাল ও পরকালের মালিক, বিচার দিনের মালিক, ন্যায় বিচারক একমাত্র প্রভু আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করি, হে দয়াময় প্রভু, হে পরাক্রমশালী প্রভু, হে রিজিক দাতা, পালনকর্তা, সম্মানিত করার মালিক, হে জ্ঞান দাতা আল্লাহ আমাদেরকে জ্ঞান খুঁজে পেতে এবং প্রাপ্ত জ্ঞান ধারণ করতে সক্ষমতা দান করুন। নিশ্চয়ই আমি বিশ্বাস রাখি, মহান আল্লাহ প্রথম যে জিনিসটি সৃষ্টি করেছেন তা হলো জ্ঞান। আ মীন।।
লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক ।