ওয়াজেদ হীরা ॥ চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী প্রায় গোটা বিশ্ব। স্তব্ধ জীবনযাত্রা। থেমে গেছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। নোভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ঘরবন্দী হয়েছে মানুষ। দেশের জনগণকে নিরাপদ রাখতে সরকার একটা লম্বা সময় সাধারণ ছুটি দিয়েছে। যা উৎসবের ছুটি নয়। বিশ^ব্যাপী মহামারী হওয়া এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো করোনার আতঙ্কে ছুটিতে থাকলেও ভাল নেই দেশের মানুষ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটে না ‘গৃহবন্দী’ সময়। কেউ কেউ ভার্চুয়াল মাধ্যমে বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। টেলিভিশন দেখে বই পড়ে সময় কাটানোর পাশাপাশি ঘরে ঘরে লুডু-দাবা খেলেও সময় কাটাচ্ছে মানুষ। বাইরে বের হতে না পারায় ঘরই এখন খেলার মাঠ হয়ে গেছে শিশুদের। সব বয়সী মানুষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার প্রত্যাশায় খোঁজ রাখছেন দেশ ও বিশ্বের। একঘেয়েমি বোধ করলে ঘরে নিজেকে ব্যস্ত রাখার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনাভাইরাস নামের জীবাণুতে কুপোকাত গোটা বিশ্ব। চীন থেকে শুরু হওয়া মহামারী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে ৬ লাখের বেশি। আক্রান্তের দিক দিয়ে সবার উপরে এখন যুক্তরাষ্ট্র। আর মারা গেছে সবচেয়ে বেশি ইতালিতে যা ১০ হাজারের বেশি মানুষ। স্পেনে এই ভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাটা ৫ হাজারের বেশি। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, করোনায় বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৪৮ জন আক্রান্তের মধ্যে ৫ জন মারা গেছেন।
ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় সারা বিশ্ব এই রোগের বিস্তার কমাতে ‘লকডাউন’ ‘শাটডাউন’র মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এই উদ্যোগ। বাংলাদেশে সচেতনতার অংশ হিসেবে এবং ব্যাপক আকারে যেন না ছড়ায় সেজন্য ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে টানা ১০ দিন সাধারণ ছুটি দিয়েছে সরকার। গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে এই সাধারণ ছুটি। প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর খোদ রাজধানী ঢাকা এখন জনশূন্য ভুতুড়ে শহর। জনমানবশূন্য রাতদিন একই রকম। রাজধানীর ব্যস্ত শহর থেকে জেলা উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারগুলোতেও লোকের সমাগম নেই।
জরুরী সেবা, নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকানপাট ছাড়া সব বন্ধ রয়েছে। সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা জনসমাগম যেন না হয় সে জন্য টহল দিচ্ছেন। এছাড়াও অনেকটা সচেতনভাবেই মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। করোনাভাইরাসের আতঙ্ক নিয়ে সবাই ঘরে অবস্থান করছেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া লোকজন ঘর থেকে একেবারেই বের হচ্ছেন না। ঘরবন্দী মানুষগুলোর কাজ না থাকায় সময়ও কাটছে না। সময় কাটাতে নানা কিছু করছেন।
গ্রামের মানুষের নিজেদের বাড়ির উঠানে কিংবা বাড়ির চারপাশে হাঁটাহাঁটির সুযোগ থাকলেও শহরের মানুষের সে সুযোগও নেই। চার দেয়ালের ইটপাথরের শহরের জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকা, ঘরের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি কিংবা সবকিছু। গ্রামের মানুষগুলো বাড়ির আশপাশ ছাড়া পাশের বাড়িতেও যাচ্ছেন না ভয়ে। আর শহরে একই ভবনে থেকে কেউ নিজ ঘরের বাইরে যেতে চান না। এমনকি ভবনের ছাদেও নয়। ২৪ ঘণ্টাই ঘরবন্দী জীবনে নানাভাবে সময় কাটানোর চেষ্টা করছেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে। রাস্তায় দোকানপাট খোলা নেই, জিমনেসিয়াম, পার্ক থিয়েটার খোলা নেই। আড্ডা দেয়ার স্থান বন্ধ, শপিংমল, সিনেমাহল সবই বন্ধ থাকায় মানুষের সবই এখন ঘরকেন্দ্রিক। জরুরী প্রয়োজনে এখনও যেসব অফিস খোলা রয়েছে তাদের অনেকেই বাসায় থেকে অফিসের কাজ করছেন। মানুষের যোগাযোগ মাধ্যম বেশি কার্যকর এখন ভার্চুয়ালভাবে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, টুইটার, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্নভাবে তথ্য আদান প্রদান করা এবং নিজেদের ঘরে থাকার অনুভূতি প্রকাশ করছেন এসব মাধ্যমে।
জরুরী প্রয়োজনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ চলছে অনলাইনের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদেরও সময় কাটছে ফোনে যোগাযোগ রেখে আর বই পত্রিকা পড়ে। কিভাবে সময় কাটছে এ বিষয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের অনলাইনে অফিস চলছে। আমরা দুটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সবাই বাসা থেকে যুক্ত থাকছি। আমাদের ছুটি নেই। আমাদের বিভিন্ন পোর্টে জাহাজ আসছে প্রতিদিনই। সড়ক পরিবহনে কন্টেনার সার্ভিস না থাকায় একটি সমস্যা হচ্ছে। আমাদের চট্টগ্রাম পোর্টে ৩৯ হাজার কন্টেনার জমা হয়ে গেছে যেখানে ক্যাপাসিটি ৫০ হাজার। এসব ডেলিভারি না হওয়াতে মনে হচ্ছে একটা বড় সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি। অনলাইনের ফাঁকে ফাঁকে আমার পত্রিকা ও বই পড়ার মাধ্যমে সময় কেটে যাচ্ছে। এলাকার মানুষদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করছি।
এমন অবস্থায় কেমন কাটছে সময় জানতে চাইলে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম জনকণ্ঠকে বলেন, শনিবারও ঢাকায় ছিলাম। বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রেখেছি মানুষের সঙ্গে। এছাড়াও দিনের অন্যান্য সময় বই পড়ি, পত্রিকা পড়ে খোঁজ নিচ্ছি। রবিবার আমার এলাকায় এসেছি। এখানে আমার নির্বাচনী এলাকার দরিদ্র মানুষদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি। স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। কেউ অসুস্থ হলে সেজন্য এ্যাম্বুলেন্স রেখেছি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময়। যেহেতু সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বলা হচ্ছে আমরাও রাখছি। তবে দেশের এমন দিনে আমরা জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। তাই ফোনে হোক কিংবা অনলাইনে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের কোন কাজ তারা অনলাইনে অনুসরণ করছেন। যেসব মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত না থাকলেই নয় তাদের বাইরে সবাই ফোনের পাশাপাশি অনলাইনে সম্পৃক্ত থাকছেন।