ফায়সাল আইয়ূবঃ
ঘুম থেকে জাগতেই শরীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। একটানা সাত আট ঘণ্টা ঘুমানোর পর সাধারণত যেমনটা হয়ে থাকে সুস্বাস্থের অধিকারী একজন সদ্যতরুণের। অথচ আমি তো এখন আর কোনো তরুণ নই! ব্যাপারটা কী! ভাবতে ভাবতে টয়লেটে গেলাম। প্রস্রাব শেষে বাথরুমে গিয়ে তো হতবাক— ছয় সাত ঘণ্টার ব্যবধানে আমার মুখের চামড়া এমন টানটান হয়ে গেলো কেমনে! ও মাই গড, মাথার চুলও পুরোপুরি কালো! স্বপ্ন দেখছি নাতো? চিমটি কাটলাম হাতে। না না, স্বপ্ন তো নয়…!
ব্যাপারটা যাচাই করতে মুহূর্তে ছুটে এলাম শোবার ঘরে। তখনও আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছে। বাতি জ্বালিয়ে ডাক দিলাম— নিপা, এ্যাই নিপা, শুনছো? আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নিপা কাঁত থেকে চিত হচ্ছে এমন সময় আমার হতবাক হওয়ার মাত্রা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। ও মাই গড, এ আমি কাকে দেখছি! আমাদের বিয়ের এক বছরের মাথায় যেমন চেহারা নিয়ে নিপা লন্ডন এসেছিলো, এ চেহারা তো তারচেয়েও টানটান!
আমার ডাকের কারণ জানবার আগে চোখ খুলতে খুলতে নিপা বলতে শুরু করলো— এ্যাই, আমার শরীরে কী রকম জানি একটা অদ্ভূত ফিলিংস হচ্ছে! বলতে বলতে নিপা চোখ কচলে আমার দিকে তাকিয়েই মুহূর্তে লেফ সরিয়ে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো; যেটা সাধারণত সে কখনোই করে না। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে কাছে ডাকলো। বসলাম। তার চোখে মুখে এক রাজ্যের বিস্ময়। আমার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রথমেই বললো— আমরা কি স্বপ্ন দেখছি, ফায়সাল! আমাকে চিমটি কাটো তো! কাটলাম। না, স্বপ্ন দেখছি না তো! আমি বললাম- আমারও তো একই কথা। আমরা বিস্ময়ে হতবাক। একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে আছি। ধাক্কা দিলো নিপা– ফায়সাল, ইহতিশাম সাফা কোথায়? আমি বললাম , তারা তো এখনও ঘুমাচ্ছে। সে বললো, চলো তাদেরকে ডেকে তুলি। আমরা একসাথে উঠতে যাবো ঠিক তখনই নিপা বললো, ফোনটা দাও তো! চার্জে ছিলো। খুলে দিলাম। ফোন হাতে নিয়েই সে ইউটিউব নোটিফিকেশনে যা দেখতে পেলো, তাতে তার বিস্ময় মাত্রা ছাড়াতে শুরু করলো। মোবাইল ফোনের স্ক্রীন আমার চোখের সামনে ধরলো। নোটিফিকেশনে ভেসে থাকা সংবাদ শিরোনাম— বেগম খালেদা জিয়ার অকাল মৃত্যু!
আমরা কিছুক্ষণ জিম মেরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি। কী হয়েছে! কী ঘটেছে! ভাবতেই পারছি না। নিপা আবারও বললো, এ্যাই আমরা বোধহয় স্বপ্নেই চিমটি কেটেছি। পুরোটাই স্বপ্ন। তার কথায় আমি আবারও কনফিউজড হয়ে গেলাম। বললাম, হতে পারে। সবই বোধহয় স্বপ্ন। নিপা বললো, না ফায়সাল এগুলো স্বপ্ন না, বাস্তব; সব বাস্তব। চলো ইহতিশাম ও সাফাতে ডেকে তুলি!
আমরা দুজন তাদের দুটি রুমের দিকে পা বাড়ালাম। আমি ইহতিশামের রুমের দরোজায় গিয়ে একটু অবাক হলাম। দরোজা ভিতর থেকে লাগানো। তাকে ডাক দিলাম। দুই তিনবার ডাকার পর সে জবাব দিলো, বাবা আমি বেরোতে পারবো না! কেনো কী হয়েছে জানতে চাইলাম। বললো, বাবা, আমার জন্যে তোমার একটা ট্রাউজার নিয়ে আসো তো! আমি আবারও বললাম, কী হয়েছে। দরোজা খোল আগে! সে আমাকে আবারও একটা ট্রাউজার নিয়ে আসার অনুরোধ করলো। আমার হাতপা অবস হবার যোগাড়; কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমাদের শোবার ঘরের অবস্থান ভিশনোগ্রাফি থেকে উদাও হয়ে গেলো! দরোজার ওপার থেকে ইহতিশাম জানতে চাইছে— বাবা, ট্রাউজার নিয়ে এসেছো? আমি শোবার ঘরের দিকে দৌড় দিবো, ঠিক ওই মুহূর্তে চোখ বড়ো বড়ো করে নিপা আমার পাশে এসে বললো— এ্যাই জানো, সাফা আমার একটি জামা চাইছে! দরোজা খুলছে না! রাতে দরোজা ভিতর থেকে কে লাগালো?
আমরা দুটি জামা নিয়ে তাদের দরোজায় গিয়ে ভিক্ষুকের মতো আবারও নক করলাম। ইহতিশাম ও সাফা দরোজার সামনে জামা রেখে সরে যেতে বললো। আমরা সরে দিয়ে ড্রোয়িংরুমে দাঁড়িয়ে বোবার মতো একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হাতপা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় নিপাকে একজোড়া মোজা নিয়ে আসতে বললাম।
কর্ণার সোফার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় খালি পায়ে ইহতিশাম ড্রোয়িংরুমে এসে ঢুকলো। তাকে দেখে আমরা যুগপৎ ক্রাইস্ট রিদিমার ও স্ট্যাচু অব লিবার্টি হয়ে গেলাম— গত রাতে ছয় বছর তিনমাস চৌদ্দ দিনের যে ছেলেকে দাঁতব্রাশ করিয়ে, মুখ ধুয়ে, ক্রিম দিয়ে, বিছানায় শুইয়ে, কপালে চুমো খেয়ে, বাতি নিভিয়ে দিয়ে, দরোজা ফাঁক করে আমরা শুতে গেলাম সে ছেলে আজ কী করে কমপক্ষে ছ’ফুট উচ্চতার টগবগে তরুণ হয়ে গেলো! আর তখনই নিপা ও আমি প্রায় একই সাথে ইহতিশামের কাছে তার বেডরুমের দরোজা কীভাবে ভিতর থেকে লক হলো জানতে চাইলাম। সে আমাদের কথার কোনো জবাব না-দিয়ে যখন তৃতীয় স্ট্যাচু হয়ে আছে, তখন নিপার জামায় আবৃত হয়ে সাফা আমাদের সামনে এসে হাজির হলো। দেখছি সে উচ্চতায় নিপাকেও ছাড়িয়ে গেছে! গতরাতে যার বয়স ছিলো মাত্র চার বছর তিন মাস ষোলোদিন, আজ কী করে একজন পুরোদস্তুর তরুণী হয়ে গেলো! সাফা আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা, আমরা কী স্বপ্ন দেখছি? সাথেসাথে আমি বললাম— না রে আম্মু না, আমরা কোনো স্বপ্ন দেখছি না!
আমরা দাঁড়িয়ে আছি অনেকটা বোবাপরিবার হয়ে।আমার কাছে আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দের অর্থ আলোকিত ডাইনিং টেবিলে রাখা পানিভর্তি স্বচ্ছকাচের গ্লাসের মতো পরিস্কার হয়ে গেলো।
সোফায় রাখা আমার মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ইহতিশাম লকস্ক্রিন খুললো। ওয়াইফাই অন করে ফ্লাইটমোড অফ করতে-না-করতেই বরাবরের মতো কয়েকটি টেক্সট মেজেস এসে ঢুকলো। লন্ডন থেকে ওয়ার্টসাপে পাঠানো ছোটোভাই তোফায়েলের একটি মেসেজ আমার চোখের সামনে তুলে ধরলো ইহতিশাম। অস্থির উত্তেজনায় আমি সেটি জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম— ‘ভাইসাব, টোমৌরো উই
উইল সেলিব্রেট আওয়ার আব্বা-আম্মা’স হানড্রেড এন্ড ফৌর্টি ফৌর্থ মেরেইজ এনিভারসেরি। উই উইল মেইক এ্যা সারপ্রাইজড ভিডিও কনফারেন্স উইথ দেম এ্যাট ইলেভেন ফিফটি ফাইভ পিএম, বাংলাদেশ টাইম। প্লিজ স্টে হোম!’
আমি থামতেই নিপা ফোনটি হাতে নিয়ে ক্যালেন্ডারে গেলো এবং দেখতে পেলো আজ পনেরো এপ্রিল ২১২০। সে সাথেসাথে তার ফোনটি খুলেও একই তারিখ ও সাল দেখতে পেলো। খুব পিপাসা পাওয়ায় এক গ্লাস পানি দিতে সাফাকে বললাম। নিপা বললো— আমিও খাবো।
এমন অদ্ভুত আকস্মিক দকল আর সইতে পারছি না; সোফায় বসে পড়লাম। কার্পেটে বসে পড়লো নিপা। ইহতিশাম তখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুই গ্লাস পানি নিয়ে সাফা আমাদের সামনে আসতেই দেখলাম তার চোখে মুখে এক আনকোরা লজ্জার ঘোমটা।
নিপা বললো— ইহতিশাম টিভি অন কর! সে সুইচ অন বোতাম টিপে রিমোর্ট কন্ট্রোলটি সোফার হাতলে রাখলো। নিপা তার মোবাইল থেকে সময় সংবাদের ওই ইউটিউব ভিডিওটি টিভিতে ট্রান্সফার করে দিলো। তরুণ সংবাদ পাঠককে প্রথমেই পড়তে শোনা গেলো— না-ফেরার দেশে চলে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির গভীর শোকপ্রকাশ। দ্বিতীয় প্রধান শিরোনাম— বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু দু’শ সাতাশি বছরে উন্নীত! বিস্তারিত সংবাদে পাঠক পড়ছেন— মৃত্যুকালে বেগম খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছিলো একশ’ বাহাত্তর বছর…!
আমি রিমোর্ট কন্ট্রোলটি হাতে নিয়ে টিভি চ্যানেল অন করলাম। বোতাম টিপে টিপে বিএফএম চ্যানেলে যেতেই দেখি চারজন ফরাসি সাংবাদিক করোনাভাইরাস সংক্রমনের শতবর্ষপূর্তি নিয়ে আলোচনা করছেন। তারা তখনকার পৃথিবীর মানুষের গৃহবন্দিজীবন, ততপরবর্তী দুর্ভিক্ষ এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন দিক তুলে ধরছেন। ওই ভাইরাস, দুর্ভিক্ষ এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে উপজীব্য করে গত শতাব্দিতে হলিউড বলিউডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছিয়াত্তরটি চলচ্চিত্র নির্মাণের তথ্যটি এক ফাঁকে একজন সাংবাদিক উল্লেখ করলেন।
ইহতিশাম জোরে জোরে হেসে উঠলো। আমরা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সে বলতে শুরু করলো— তাহলে তো আমরা বেঁচে গেছি! আমাদের হোম কোয়ারেন্টিন শেষ! আমরা আজই ঘর থেকে বেরোতে পারবো! পার্কে যেতে পারবো! বাবা আম্মা সাফা জলদি রেডি হও! আমরা আজ বাইরে খাবো; কতোদিন বাইরে খাওয়া হয়নি! কেএফসিতে যাবো…
ইহতিশামকে থামিয়ে দিয়ে নিপা বললো— তোদের তো কাপড়চোপড়-ই নেই; কী পরে বাইরে যাবে। দাঁড়া, তোদের জন্যে জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসি! ওঠো ফায়সাল! সাফা, আমার পার্টস আর গাড়ির চাবিটা দে তো!
হ্যাঁ, চলো! বাইরে গেলেই বুঝতে পারবো উই আর ইন ড্রিম অর নট।
বাইরে থেকে দরোজা লক করতেই নিপা বললো— খেয়াল করেছো, এই প্রথম ইহতিশাম ও সাফাকে ঘরে রেখে আমরা বেরোলাম! আমি বললাম— হ্যাঁ, তাই তো। এখন থেকে তাহলে আমরা দুজন একসাথে বেরোতে পারবো।
লিফটের সামনে গিয়ে দেখি লিফট ডাকার কোনো বোতাম নেই। মুখ বরাবর ছোটো আকারের তিনটি ছিদ্র। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই অপ্রতিবেশি এক নারী সেখানে উপস্থিত হলেন। এক সেকেন্ডের জন্যে তিনি আমাদের দিকে কিছুটা অবাক হয়ে তাকালেন। আমরা সরে দাঁড়াতেই তিনি ছিদ্রের কাছে মুখ নিয়ে শুধু বললেন— হ্যালো! লিফটের দরোজা খুলে গেলো! তার সাথে আমরাও ভিতরে ঢুকে গেলাম।
এপ্রিল ১৫, ২০২০।। প্যারিস, ফ্রান্স।