- মোঃ শামছুল আলম
রমজান শব্দটি রমজ থেকে এসেছে যার অর্থ দাহন। মানব জীবনে কুপ্রবৃত্তির বিনাশ বা দাহন জরুরি। আর এর ফলেই মানব সমাজে সংহতি, প্রেম ও একতা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে কুপ্রবৃত্তিগুলো মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও অসহায় করে মানব জীবনকে অন্ধকারের অতল তলে তলিয়ে দেয় এবং মানব জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য সাধনকে অসম্ভব করে তুলে। কামপ্রবৃত্তির অসংযত চর্চা মানুষকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দেয়। ক্রোধ মানুষকে করে জ্ঞানশূন্য। লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা বয়ে আনে। এসবের চর্চা মানুষের আত্মাকে করে কলুষিত ও আত্মিক উন্নতিকে করে ব্যাহত। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয় তেমনি রোজাও কুপ্রবৃত্তিগুলোকে পুড়িয়ে মানুষকে করে খাঁটি মানুষ। ফলে সে হতে পারে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার যোগ্য বান্দা। আর আত্মিক উন্নতির মাধ্যমে সে পেতে পারে মহান আল্লাহর সাক্ষাত বা নৈকট্য। আর এসব কারণেই এ মাসকে বলা হয় রমজান মাস।
রোজার গুরত্বঃ
২য় হিজরী শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় “হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)
সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে।
হাদিসে এসেছে, হযরত শাহ্ ইবনে স্দা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা:) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরাজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেনা। (বুখারী, মুসলীম)
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবী হযরত শাহ্ ইবনে সাদ (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা:) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজা গুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী,মুসলিম)
হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রাতে এবাদত করে তার পূর্বে সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বে সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী,মুসলীম)
হাদিসে আরো এসেছে, রাসূল (সা:) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে তার রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরষ্কার দেব। রোজা (জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরুপ।
তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথা বার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেন লিপ্ত না হয়। কেউ তার সঙ্গে গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার ।
রোজার ফজিলতঃ
রমজানের ফজিলত নিয়ে অনেক হাদিস বিভিন্ন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। হযরত সালমান ফারসী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, একবার রাসূল (সা:) আমাদের শাবান মাসের শেষ তারিখে ভাষণ দান করলেন এবং বললেন , হে মানব মন্ডলী! তোমাদের প্রতি ছায়া বিস্তার করেছে এক মহান মাস, মোবারক মাস। এটি এমন মাস যাতে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালা এই মাসের রোজা গুলোকে করেছেন (তোমাদের উপর) ফরজ আর রাতে নামাজ পড়াকে তোমাদের জন্য করেছেন নফল।
এই মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করল সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এই মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো যে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো।
এটা ধৈর্য্যের মাস। আর ধৈর্য্যর সওয়াব হলো বেহেশত। এটা সহানুভুতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস যে মাসে মুমিন বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার জন্য গুনাহ মাফের এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার ছওয়াব হবে রোজাদার ব্যক্তির সমান। অথচ, রোজাদার ব্যক্তির সওয়াব কমবেনা। এসব শুনে সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রসুল (সা:) আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ্য রাখেনা যে রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করাবে?
তখন রাসুল (সা:) বললেন ,আল্লাহ পাক এই ছওয়াব দান করবেন যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে, অথবা একটি খেজুর দিয়ে অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন যার পর সে পুনরায় তৃষ্ণার্ত হবেনা জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত।
এটা এমন পবিত্র মাসের প্রথম দিক রহমত, মাঝের দিক মাগফিরাত, আর শেষ দিক হচ্ছে দোযখ থেকে মুক্তির। যে ব্যক্তি এই মাসে আপন অধীনস্থ দাস-দাসীদের কাজের বোঝা হালকা করে দেবে মহান আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন এবং তাকে দোযখ থেকে মুক্তি দান করবেন। (বায়হাকী)
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তার ‘এহয়াউল উলুম’ গ্রন্থে রহমতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘রোজাদার বান্দা যখন নিদ্রা যান, তখন তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের বদৌলতে আল্লাহ তাসবিহ পাঠের প্রতিদান দান করেন। এ ছাড়া সেহরি, ইফতার, তারাবির নামাজ, তেলাওয়াতে কোরআন, তাসবিহ-তাহলিল এবং অপরাপর ইবাদত-বন্দেগিতেও সওয়াব অন্য মাসের চেয়ে ৭০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
রোজার উপকারীতাঃ
অনেক মুসলমানই স্বাস্থ্যজনিত কারণ দেখিয়ে রোজা রাখেন না, অথচ কুরআনে কারীমে রোজা রাখার ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। রোজার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রোজা পালনের ফলেই পাওয়া যায়। সাধারণত “উপবাস” চিকিৎসা পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন-ওজন নিয়ন্ত্রণ , পরিপাক নালীর আরাম ও অতিরিক্ত চর্বি কমাতে ইত্যাদি। পরিপূর্ণ উপবাসের নানা বিরূপ প্রভাব রয়েছে এমনিভাবে তথাকথিত ক্র্যাশ ডায়েটেরও। সাধারণ উপবাসের তুলনায় রমজানের উপবাস তথা রোজা একদমই ভিন্ন পন্থা। কেননা, রমজানের রোজায় কোন অপুষ্টি বা অপর্যাপ্ত ক্যালোরি গ্রহণ করা হয় না।রমজান মাসে মুসলমানদের ক্যালোরি গ্রহণ হয় যথাযথ মাত্রায় বা তার চেয়ে নিচে। উপরন্তু, কোন ডাক্তারি নির্দেশনা ছাড়াই রমজানের রোজা স্বেচ্ছায় রাখা হয়, আর এর সুফলও পাওয়া যায় ।
১৭৬৯ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ পিটার ভেনিয়ামিনভ রোজা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। সেই রিপোর্টে তিনি মানুষকে রোজা রাখার উপদেশ দেন। তার যুক্তি ছিল রোজার কারণে পরিপাকতন্ত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশ্রাম পায়। ফলে সুস্থ হবার পর তা ঠিক মত নিজের কাজ চালাতে পারে।
মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ পিজি স্পাসকি বলেন, রোজার মাধ্যমে কালাজ্বর ও শরীরের অন্যান্য পুরাতন রোগ কোন মেডিসিন ছাড়াই ভালো হয়ে যায়।
জার্মান ডাক্তার ফেডারিক হ্যানিম্যান বলেন, রোজার মাধ্যমে মৃগী রোগ ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়। এছাড়াও পেটের অসুখ, অজীর্ণ, বদহজম, গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসাও করা যায়।
ইতালির বিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলা ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর পার হবার পরও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। এর রহস্য জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আমি বহু বছর আগে থেকে মাঝে মাঝে রোজা রেখে এসেছি। আমি প্রত্যেক বছর এক মাস ও প্রতি মাসে এক সপ্তাহ রোজা পালন করতাম।”
এমন অনেক উদাহরণ আছে যারা রোজার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবী ডাক্তার গবেষকরা ভালো করেই জানেন মহান স্রষ্টা অকারণে রোজাকে ফরজ করেন নি। কারণ তারা কুরআন ও ইসলামের নিয়ম কানুন নিয়ে রীতিমত পড়াশুনা ও গবেষণা করেন।
রমজান মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি, জিকির, কোরআন তেলাওয়াতের আমল জারি রাখা উচিত। সেই সঙ্গে গিবত, শেকায়েত, পরনিন্দা, পরচর্চা পরিহার করে চলতে হবে। কেননা এগুলো রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থি কাজ। এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই রোজা নয়; বরং বেহুদা-অযাচিত কথাবার্তা থেকে বিরতও গুরুত্বপূর্ণ।
মাহে রমজানের মধ্যে জাগতিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির বার্তা রয়েছে। ইহকালীন কল্যাণ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই রোজাদার পারলৌকিক শান্তির পথ রচনা করবে। তাই সিয়াম-সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভ করে ক্ষমা, মুক্তি ও নিষ্কৃতিপ্রাপ্তদের মধ্যে নিজেদের অধিষ্ঠিত করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের একান্ত কাম্য হওয়া উচিত।
এবারের রমযান মাস একটু ব্যতিক্রম। পুরো পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। আর এতে মুমিনের ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। এমনও হতে পারে মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা জন্যই এমন মুসিবত পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
বিভিন্ন যুগে আল্লাহ পাক তার প্রিয় বান্দাদের এমন অসংখ্য বালা মুসিবতে ফেলেছেন। আবার তিনি নিজ গুনেই এসকল বিপদ থেকে তার প্রিয় বান্দাদের উদ্ধার করেছেন।
হয়তো রমযানের এই পবিত্রতা আবার ঠিক করে দিবে পুরো পৃথিবী। সারা বিশ্বে আবার জাগরিত হবে লক্ষ কোটি প্রাণ। মানবজাতি যে সৃষ্টিকর্তার কাছে কত অসহায় তা প্রমাণের জন্যই হয়তো এমন পরীক্ষা।
হে আল্লাহ! রমজানকে আমাদের জন্য শান্তিময় করে দিন। রমজানের শান্তি মুসলিম উম্মাহকে দান করুন। রমজানের রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে মহামারি করোনাভাইরাস থেকে মুক্তো করে দিন।
আমিন।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক।