- সালাম ফারুক
১৯৫২ সাল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে উত্তাল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলি করে বাঙালি হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিভিন্ন স্থানে। বিক্ষুব্ধ ছিল সিলেটও। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা চার দিন চলে হরতাল-সমাবেশ। লাগাতার কর্মসূচির শেষ দিন অর্থাৎ ২৫ তারিখ সিলেটের বিশাল সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তরুণ এক আইনজীবী। নাম তার মনির উদ্দিন আহমদ।
১৯২৩ সালের ১১ মার্চ আসাম প্রদেশের তৎকালীন কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমার কুচিলা চা বাগানে জন্ম মনির উদ্দিন আহমদের। নানা ছিলেন ওই বাগানের মালিক। পৈতৃক নিবাস ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জের সতুনমর্দন গ্রামে। তিনি ১৯৪১ সালে হাইলাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪৫ সালে আসামের শিলচর গুরুচরণ কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আইনের ছাত্র হিসেবে ১৯৪৮ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনটি বিষয়ে সম্মানসূচক নম্বরসহ এলএলবি এবং ইতিহাসে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
হাইস্কুলে থাকাকালীন ১৯৪০ সালে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন মনির উদ্দিন আহমদ। একই বছর তৎকালীন মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের হাইলাকান্দি মহকুমা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দেশভাগের সময়, অর্থাৎ সিলেটের রেফারেন্ডামে এবং ১৯৫২ সালে নবীন আইনজীবী হিসেবে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৩ সালে তিনি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পাকিস্তান গণতন্ত্রী পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির গঠন প্রক্রিয়ায় অঙশ নেন। তিনি বিভিন্ন সময় সিলেটে জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবে চা শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লেবার ইউনিয়ন, ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই শ্রমিক ইউনিয়ন এবং সিলেট জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্ব দেন।
মনির উদ্দিন আহমদ ১৯৫০ সালে আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯৭২ সালের মার্চ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৩ বছর সরকারি কৌঁসুলির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দুবার জেলা বারের সভাপতি নির্বাচিত হন।
মনির উদ্দিন আহমদ ১৯৮২ সালে সিলেট ল কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। বছর পাঁচেক পরই পান অধ্যক্ষের দায়িত্ব। কলেজের ভূমি বন্দোবস্ত, স্থায়ী ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নের পেছনে তার একাগ্রচিত্ত কর্মব্যস্ততা তাকে একজন সফল ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সিলেট ল কলেজ ছাড়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের সদস্য, কুশিয়ারা কলেজ এবং বসন্ত মেমোরিয়াল স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে তাকে সম্মাননা দেয় সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেট। তবে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা জোটেনি তার।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হলেও তার চালচলন ও আচার-ব্যবহার ছিল একেবারে সাধারণের মতো। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীদের কাছে তাই তিনি ছিলেন খুবই প্রিয়জন। শুধু দেখতাম, সবাই তাকে পিপি সাহেব বলে ডাকতেন। ২০১৯ সালের ২ মে দিবাগত রাতে না ফেরার দেশে চলে যান বাহান্নর সেই তুখোড় সৈনিক। পরদিন শুক্রবার সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাকে শ্রদ্ধাভরে শেষ বিদায় জানায় সিলেটবাসী। এরপর বাদ জুমআ হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাাহি আলাইহির দরগায় জানাজার নামাজ শেষে সেখানেই দাফন করা হয় তাকে। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
তথ্যসূত্র: ১. আব্দুল হামিদ মানিক রচিত সিলেটের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
২. আইন পেশায় ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির দেয়া মানপত্র।
৩. স্থানীয় সংবাদপত্র।
লেখকঃ কবি, সাংবাদিক।