আমিনুল ইসলাম রোকন:
কামরান- হৃৎপিণ্ডের প্রতিনিয়ত দপ দপ শব্দের মতোই সিলেটের রাজনীতিতে উচ্চারিত এক নাম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কম সংখ্যক যেসব নেতা মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিলেন কামরান ছিলেন সেই বিরলপ্রতিম একজন। এই নামটি ঘিরে সিলেটে তাই অন্যরকম এক মাদকতা। যে কারণে দল, মত নির্বিশেষে সিলেটের শান্তি-সম্প্রতির প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছিলেন কামরান। সিলেট নগরের সাথেও এক অলৌকিক প্রেমের সম্পর্ক তৈরী করে নিয়েছিলেন নিজের অজান্তেই।
রাজনীতির মাঠে দীর্ঘ বিচরণ। অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় ধরে তিলে তিলে গড়েছিলেন বর্ণ্যাঢ্য ক্যারিয়ার। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা হয়েছেন সিলেটের প্রিয় নাম। সিলেটৈর শেষ পৌর চেয়ারম্যান আবার প্রথম সিটি মেয়র দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন অনন্য রেকর্ড কেবল তাঁর- ই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সিলেটের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনও সেই নামটি-বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। প্রিয় সেই নামটি ঘিরে এখন অন্তিম শূণ্যতা, কেবলই হাহাকার।
বর্ষীয়ান শব্দটি সবার সাথে যায়না। হীরক দ্যুতিমময় কর্মযজ্ঞে কোন কোন নাম বর্ষীয়ান হয়ে উঠে।
সিলেটের রাজনীতির আকাশে নক্ষত্র হয়েই আলো ছড়িয়েছিলেন কামরান। কামরানের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কও অনেক দিনের পুরনো। ছাত্র অবস্থায়ই ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। দীর্ঘদিন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দায়িত্ব সামলেছেন। তবে কামরান আলোচনায় আসেন সেই তরুণ বয়েসেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পৌর নির্বাচনেই চমক দেখিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে যখন প্রথমবারের মতো পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন টগবগে তরুণ। স্থানীয় মুরব্বিদের অনুরোধে সিলেট পৌরসভার ৩নং ওর্য়াডের (তোপখানা) কমিশনার পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মুরব্বিদের চাওয়া বৃথা যায়নি, কোদাল প্রতীকে ৬৪৪ ভোট পেয়ে কামরান পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হন। পরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে, সেবারও কমিশনার নির্বাচিত হন কামরান। মাঝে কিছুদিন প্রবাসে চলে যাওয়ায় নির্বাচনী লড়াই থেকে দূরে ছিলেন তিনি। ১৯৮৯ সালে আবার ফিরেন নির্বাচনী ময়দানে। আরো একবার কমিশনার নির্বাচিত হন। এরপর কামরান তার দৃষ্টিকে আরো দূরে ছড়িয়ে দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে লড়াইয়ে নামেন। বিজয়ীও হন। এরপর শুধুই আলোর ইতিহাস। ১৮ বছর ধরে কামরানই ছিলেন সিলেটের নগরপিতা। এ সময়ের মধ্যে পৌরসভার যুগ পেরিয়ে সিলেট পা রেখেছে সিটি কর্পোরেশন যুগে। আর কামরানের ঝুলিতে জমা হতে থাকে একের পর এক সাফল্য। একজন ব্যাক্তি কামরান থেকে হয়ে উঠেন জনতার কামরান।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয় ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট তখন ক্ষমতায়। তৎকালীন সিলেট-১ আসনের এমপি ছিলেন মরহুম এম. সাইফুর রহমান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহানগর আওয়ামীলীগ সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এবং বিএনপির প্রার্থী তৎকালীন জেলা সভাপতি এম.এ হক। এই নির্বাচনে চারদলীয় জোট কোমর বেঁধে মাঠে থাকলেও বিএনপির একাংশ নিজেদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বিএনপির বিভেদের কারণে অনুকূল সময়েও নির্বাচনের সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। প্রথম নির্বাচনে ধাক্কা খেয়ে তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর এই সুযোগে সিলেট সিটিতে একক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন কামরান। পৌরসভার কমিশনার থেকে চেয়ারম্যান, অতঃপর মেয়র। এভাবে কামরান হয়ে উঠেন সিলেটের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা তার। তৈরি হয় নিজস্ব ভোটব্যাংক। এ কারণে ২০০৮ সালের ৪ আগস্টে কারান্তরীণ থেকেও বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। প্রায় ৪ যুগের অভিজ্ঞতা। সিলেটের শেষ পৌর চেয়ারম্যান, আবার প্রথম সিটি মেয়র- দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কামরানের এমন অনন্য রেকর্ড।
ইতিহাস সৃষ্টির এই মহা নায়ক এখন মহাসিন্ধুর ওপারের বাসিন্দা। মৃত্তিকার রহস্যময় অন্ধকার ঘরে চিরশয্যা নিয়েছেন তিনি। যেখান থেকে আর কোনদিন ফিরবেননা তিনি। তবে সিলেটবাসীর হৃদয়ে কামরান ঠিকই হেটে চলবেন একান্ত নিঃশব্দে। মৃতসব প্রিয়জনরা স্বপ্নের ভেতর যেমন বিষণ রকমে বেঁচে থাকেন, কামরানও বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। অধ্যাত্মিক এ নগরে তাঁর রেখে যাওয়া অলৌকিক প্রেমও বিষণ্ণ শোক উড়াবে অনন্তকাল।