মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Sex Cams

একমুঠো রোদ্দুর




রুনা তাসমিনা 

এত সবুজ! ঘাসগুলো দেখে মনে হচ্ছে,যেনো কোনো রূপসী মেয়ে বিছিয়ে রেখেছে তার শাড়ির সবুজ আঁচল। সীমানা প্রাচীর কিংবা মাঝে মাঝে হঠাৎ করে হাত ধরাধরি করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেনো সৈনিক। ইচ্ছে করে মিলিয়ে যাই এই সবুজ ঘাসের বুকে। কিংবা পাখি হয়ে বসে থাকি ওই সবুজ গাছের ডালে। নাহয় ছোট্ট যে পানির ফোয়ারা ঘাসের বুকে ডুব দিয়ে আছে? মাছ হয়ে সাঁতার কাটি তাতে। মাঝে মাঝে উবু হয়ে বসে  থাকা ছোটো ছোটো অলকানন্দা গাছে ফুটে থাকা অজস্র ফুল যেনো ডাক দিয়ে বলে, কাছে আয়। কাছে আয়। বিকেল নামতেই ঝাউবনের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা নারকেল গাছের চিরল পাতা থেকে সূর্যটা যখন বিকেল স্নান করে বেরুলো, অদ্ভুত মায়াময় এক জগৎ তৈরি হলো! কী মোহনীয় সৌন্দর্যের ছটা যে ঐ সময় তার গা থেকে ঝরে পড়ে তা যদি ঐ নারকেল গাছটা জানত! কে জানে! হয়তোবা জানেও! কানাকানি করে হয়তো ওরা বিদায় নেয় একে অন্যের কাছ থেকে! হয়তো কাঁদে একরাতের দূরত্বের বিরহে। আমি কী ওদের ভাষা বুঝি? কিন্তু আমার যে ইচ্ছে করে ওদের সঙ্গে কথা বলতে! ঘাসের গালিচা বিছানো মাঠে বুক পেতে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ও-ই যে আকাশ! যে ঝাউগাছের পাতার উপর দিয়ে ওপারে হারিয়ে গেছে,ঠি-ক তার মাঝখানে হাতটা রেখে দিতে! সারাদিন ঘুরে ঘুরে নিজের ঠিকানায় ফিরে যাওয়া ক্লান্ত পাখিদের একজন যদি বসে পড়ে সেই হাতে! ভোরবেলা যখন শিশির জমে ঘাসের ডগায়,তখন কি ওগুলো মেয়েদের নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামের মতো লাগে? কোথায় যেন শুনেছিল,নাকের ডগায় ঘাম জমে থাকা মেয়েদের নাকি পুরুষরা বেশি ভালোবাসে। কথাটি মনে হতেই নিজের অজান্তে একচিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে রিয়ার ঠোঁটের কোণে। নাকের ডগায় জমে থাকা ঘাম আলতো হাতে মুছে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে পিয়াল আর ওর বন্ধু ফিরে আসছে। ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দেয় ব্যাগের মধ্যে। গলফ ক্লাবের লবিতে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল রিয়া এখানকার সৌন্দর্য। কতবছর ধরে ঘর থেকে বেড়ানোর জন্য বের হওয়া হয়না। আজ পিয়াল একরকম জোর করেই টেনে বের করে আনলো।

-কি রে, কি লিখছিলি? এখানে বসেও বাজারের লিস্ট করছিস নাকি?

রিয়া হেসে দেয় পিয়ালের কথা শুনে।

-না। তোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্যে। পিয়াল?কোথাও কী এখানে শিউলি ফুল ফোটে? সকালে বিছিয়ে থাকে ঘাসের উপর? কেউ কী সেই ফুল কুড়িয়ে নিয়ে মালা গাঁথে আমার মতো করে?

-তুই এখনো ভুলিস নি! তোদের উঠোনের সেই শিউলি ফুলের কথা! তুই মালা গাঁথতি ওই ফুলে। আর আমি জোর করে কেড়ে নিয়ে গলায় পরে ঘুরতাম?

-শৈশবের কথা কেউ ভোলে? খুউব মনে আছে। চোখের তারায় যেনো শৈশব ঝিলমিলিয়ে ওঠে রিয়ার।

-তোর কাব্যচর্চা তাহলে এখনো চলে।

বিকেলের নরম আলোয় গলফ ক্লাবের সবুজ মাঠ আরো সবুজ দেখায়। ওদিকে তাকিয়ে কিছুটা আনমনে বলে,

-না রে। অনেক বছর পর এত সবুজ একসঙ্গে দেখে মন ভরে গেছে। তা- ই দেখছিলাম মনভরে। শহর এলাকায় এতো সবুজ আছে,তুই এখানে না নিয়ে এলে বিশ্বাসই হত না।

হেমন্তের বিকেল সূর্য চোখের পলকেই গড়িয়ে যায় আরো পশ্চিমে। গলফ ক্লাবের চারপাশ ঘিরে নেমে আসছে অন্ধকার। বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলে উঠছে একে একে। মাঠের সবুজ ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ছে সন্ধ্যার ছায়ায়। ঘাসগুলোতে ধরেছে কেমন কালচে রঙ। লবিতে বসে গল্প করছে ওরা তিনজন। চা,বিস্কুট দিয়ে গেলো একজন ওয়েটার।

-তোর ভেতরে সবুজ এখনো বেঁচে আছে শুনে ভালো লাগলো। চায়ের কাপে চুমুক দেয় পিয়াল।

-তোদের বাড়ির উঠোনটা ঠিক এমন সবুজ ছিল।না রে রিয়া? রাতে ঝরে পড়া কামিনী আর শিউলি ফুলগুলো ঘাসের উপর কী সুন্দর করে পড়ে থাকতো!

-একদম আমার মনের কথাটাই বলে দিলি! বাড়ির কথাই মনে পড়ছিল। ওটা বিক্রি করে দেয়ার পর আর যাওয়া হয় নি কখনো। কেমন উদাস শোনায় রিয়ার কথাগুলো।

-শহুরে জীবন আর তোর সংসার নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে গেছিস যে,জানিসই না জীবন এখন কত বদলে গেছে! আচ্ছা, ওসব কথা বাদ। কথার মোড় অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করে পিয়াল।

-জানিস বাবলু,বন্ধুর দিকে ফিরে বলে পিয়াল। রিয়া কিন্তু ভালো গাইতো। কবিতাও লিখতো লুকিয়ে লুকিয়ে।

-কী হচ্ছে পিয়াল! আবার সেদিনের কথা টেনে আনছিস? আচমকা এই প্রসঙ্গে কিছুটা অপ্রস্তুত সে।

-বিব্রত হচ্ছেন কেন? আপনি গাইতেন,লিখতেন এগুলো তো খুব ভালো। রিয়ার কথার উত্তর বাবলুই দেয়।

-কিন্তু আমার কারণে সেসব বন্ধ করে দিয়েছিল সে।

-তোর কারণে! কিছুটা আশ্চর্য হয় বাবলু।   -হ্যাঁ রে। আমার কারণে। ওকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলাম একদিন। কবিতার খাতাটা চুরি করে স্কুলে নিয়ে দেখিয়েছিলাম সবাইকে। ক্লাসের সবাই খুব হাসাহাসি করেছিল। সেদিন থেকে সে আর লিখেনি। তবুও কবি কবি বলে ক্ষেপাতো, হাসতো সবাই। আমি ঠিক করিনি রিয়া। তোর খাতা  ক্লাসে বড় বড় করে পড়ে শোনানোটা একদম উচিত হয় নি। তুই লজ্জায় একেবারে  কুঁকড়ে গিয়েছিলি। সরি রিয়া। সেদিন বুঝতে পারিনি। তুই খুব কষ্ট পেয়েছিলি। । অনেকদিন আমার সঙ্গে কথাই বলিসনি। অনুশোচনা পিয়ালের কথায়।

-তুই থামবি? আমি চললাম। রিয়া রাগ করে উঠে দাঁড়ায়।

পিয়াল আবার ‘সরি’ বলে হাত ধরে টেনে বসায় তাকে।

-ঘুরাতে নিয়ে এসে পুরনো কথার প্যাঁচাল পাড়ছিস শুধু শুধু। রিয়া রেগে আছে এখনো।

-আচ্ছা। আর বলবো না। তোকে গুণে গুণে আর সাতদিন জ্বালাবো। তারপর আবার সেই শহর,যেখানে রাত হয় না সেখানে ফিরে যাবো। সেই রুটিনের ঘরকাটা বাঁধা জীবন। ছকের একটুও এদিক সেদিক হওয়ার জো নেই…

-সেই পর্যন্ত এই আমাকেই শুধু দেখেন জনাব। পিয়ালের কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে গুমোট হয়ে ওঠা পরিবেশটা রিয়াই হালকা করে দেয়।

-আপনার একটা গান শুনবো রিয়া। বাবলু অনুরোধ করে।

-বাহ! খুব দারুণ একটা কথা বলেছিস তো বাবলু।গানের জন্য এর চাইতে উপযুক্ত পরিবেশ আর হয় না। রিয়া ম্যাডাম! একটা গান প্লিজ! দুষ্টুমির সুর পিয়ালের কথায়।

রিয়ার মনে গুনগুন করে উঠছে সুর। ঠিক সেই মুহুর্তে ফোন। বাসা থেকে।

-বড়াপু তুই কখন আসবি? ছোটনের গলা।

-এই তো আসছি। কী হয়েছে রে ছোটু? মা কেমন আছে?

-মা ঠিক আছে। আমার একটু দরকার ছিল তোকে।

-ফোনে বল্।

-বাসায় আয়। তারপর বলবো।

-আচ্ছা আসছি। আধঘন্টার মধ্যেই চলে আসছি। ফোন কেটে দিয়ে পিয়ালকে তাড়া দেয় চলে আসার জন্যে। বাবলুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দু’জন।

বাসায় ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে রিয়া। বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য আলমারি থেকে ছোটুকে শার্ট-প্যান্ট বের করে হাতে গুঁজে দেয় কিছু টাকা। খুশি মনে বেরিয়ে পড়ে সে।

-মা’কে কিছু খাইয়েছিস রিমি?

-তুই ছাড়া মা কারো হাতে কিছু খায় বড়াপু? আমি সাধলাম। মা বললো, তুই আসলে খাবে।

-ইস! অনেক দেরি হয়ে গেলো। রিমি, তুই পিয়ালের বিছানাটা ঠিক করে দে। আমি মা’য়ের কাছে যাচ্ছি।

আধঘন্টা আগের রিয়ার সঙ্গে এই রিয়ার কোনো মিল নেই। এই কয়দিনে পিয়াল বুঝেছে সেদিনের সেই চঞ্চল,মেধাবী  মেয়েটি এখন অনেক স্থির। নিশ্চয় সে-ও বুকে জমা রেখেছিল কোনো স্বপ্ন। কিন্তু অকালে খালুর মৃত্যুর কারণে আজ সে এই পরিবারের পাকা অভিভাবক। বিছানায় শুয়ে পিয়াল ভাবে,কী অদ্ভুত মানুষের জীবন! দাবার ছকের মতো কেমন হুট করে পাল্টে যায়!

বাবা-মা’র কাছে এটা ওটা বায়না ধরা মেয়েটি এখন নিজেই পূরণ করে ছোটো ভাইবোনের নানা আবদার। ছোটন,রিমি, রিপার বড়াপু শুধু নয়,মা-বাবাও। রিয়া। পিয়ালের খালাতো বোন। সমবয়সী। ছোটোবেলা থেকেই দু’জনের মধ্যে ঝগড়া, অভিমান যেমন হতো, তেমনি বন্ধুত্বটাও ছিল বেশ গভীর। বার্ষিক পরিক্ষা এলে দু’জনের আপ্রাণ চেষ্টা ফার্স্ট হওয়ার।  নিবিড়, নিটোল এক বন্ধন। যেমন নদীর সঙ্গে সাগরের। অনার্স শেষ করেই পিয়াল চলে গেলো অস্ট্রেলিয়া। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার ব্যস্ততার মধ্যেই জেনেছিল খালুর মৃত্যুর খবর। ফোনে সান্ত্বনা জানিয়েছিল রিয়াকে। সময়ের কাছে মানুষের সবসময়ই হেরে যায়। তাই হয়তো প্রথমদিকে যেমনটি খবর নেয়া হত,ব্যস্ততার কারণে সেটি পরে আর ওভাবে নেয়া হয়নি। দেশে আসার পর রিয়াদের ঘরে পা দিয়েই উপলব্ধি করলো,জীবনের দু’পিঠ কী।

রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে রিয়ার ব্যস্ত গলার স্বর। রিমির পরিক্ষা চলছে। পিয়ালের বিছানার পাশের টেবিলে বসে পড়ছে সে। রিপা, বড়াপুকে টুকটাক সাহায্য করছে। ব্যস্ততার মাঝেও মুখের ঘাম মুছতে মুছতে রিমির পড়া দেখিয়ে দিচ্ছে এসে। সেইসঙ্গে পিয়ালের খিদে লেগেছে কীনা সে খবরও নিচ্ছে।

বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ছোট ঘরের ছোট্ট জীবনটি দেখতে দেখতে কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন পিয়াল।

-পিয়াল,ঘুমিয়ে পড়েছিস? রিয়ার ডাকে -চোখ খুলে দেখলো রিমির পড়ার টেবিল থেকে বইখাতা সরে গিয়ে ভাত-তরকারির বাটিতে ভরে উঠেছে।

-একটু দেরি হয়ে গেলো রে। মাকে ইনসুলিন দিলাম। রুটি খাইয়ে,শুইয়ে দিলাম। তাড়াতাড়ি আয়। আজ তোর জন্যে শোল মাছ রান্না করেছি। তোর পছন্দের মাছ। কথার ফাঁকে ভাতের প্লেটগুলো চটপট হাতে টেবিলে বিছিয়ে দিল।

-ভালোই সংসারী হয়েছিস। মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসে বললো পিয়াল।

-আমাদের ছোটো ঘরে ছোটো ছোটো সুখ কে যেন লিখেছিলেন? শোল মাছের বড় টুকরোটি পিয়ালের পাতে তুলে দেয় রিয়া। মুখে হাসি।

পিয়াল বুঝে নেয় ওদিকে যেতে চায় না সে। তাই রিয়ার হাসিতে যোগ দিয়ে খাওয়ায় মন দেয়।

-তোর কাজ শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে রিয়া?

– বেশিক্ষণ না। কেন?

-ছাদে যাবো। রাতের আকাশ অনেকদিন দেখিনি। দেখতে ইচ্ছে করছে। তুই ও আয় না!

– তুই খাওয়া শেষ করে চলে যা। আমি আসছি একটু পর।

শহরের একপ্রান্তে রিয়াদের দোতলা বাড়িটা। আশেপাশে উঁচু দালানের দৌরাত্ব এখনো শুরু হয় নি এখানে। নেই নিয়নের চোখ ধাধানো আলো। ঝিঁঝি পোকার একটানা নিশ্চিন্ত ডাক ভেসে আসছে নীচ থেকে। হাওয়ায় মিশে আছে হাসনাহেনার মন উদাস করা মাতাল ঘ্রাণ। জোছনার আলোয় জোনাকিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, যেনো কতগুলো তারা ছুটোছুটি করছে। উপরের তারাভরা আকাশে একফালি চাঁদ। নীচে বাঁধনহারা জোনাকিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, যেনো আর কতগুলো তারা ছুটোছুটি করছে। অপূর্ব এক সৌন্দর্য মিশে রয়েছে রাতের কালোর সঙ্গে। হেমন্তের বাতাসে শীতল অনুভূতি। পিয়াল এর আগে কখনো এতো মনযোগ দিয়ে রাতকে দেখেনি। পেছনে  পায়ের শব্দে ফিরে দেখলো রিয়া আসছে।

-তোরা তো স্বর্গে থাকিস রে রিয়া। রিয়ার দিকে ফিরে বললো।

-বাবার রেখে যাওয়া এই ঠাঁই আসলেই আমাদের স্বর্গ। না হলে নরকেও জায়গা হত কিনা কে জানে।

-বেশ বড়ো হয়ে গেছিস। পাকা পাকা কথা শিখেছিস।

-বড়ো হই নি,তবে বুড়ো হয়েছি সেটা বেশ বুঝতে পারি। দু’জনের হাসির শব্দ মিশে যায় ঝিঁঝি পোকার ডাকের সঙ্গে।

-কী জীবন পেছনে ফেলে এসেছি,তাই না রে রিয়া?

-সুন্দর তো আসেই চলে যেতে। বাবাটা যে কেন হুট করে চলে গেলো! দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রাখে রিয়া।

-বিয়ে করিস-নি কেন রিয়া? কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও পিয়ালের এই অভ্যেসটা তার বেশ জানা আছে। কোন ফর্মালিটির ধার ধারেনা সে কাছের মানুষদের কাছে।

– আমি চাইলেই কি হবে? যখন দু’,তিনজন এসে দেখে গিয়ে আর কিছু জানালো-না বুঝলাম, মেয়ে পছন্দ হয় নি। বাবা কত ফেয়ার এন্ড লাভলি কিনে এনে দিয়েছিল! আমিও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কখনোই ভুলতাম না লাগাতে। হা হা… কিন্তু কালো চামড়াটা আর শাদা হলো না।

-আমি যদি কোন ছেলে ঠিক করি, তুই অমত করবি না তো?

-আমার ঘরটাকে আগে আরেকটু গুছিয়ে নিই! তারপর তোকে বলবো।

-যদি এমন হয়- তোর ঘরও গোছানো হবে,তোর নিজেরও একটা একান্ত জীবন থাকবে তখন?

– এখন না পিয়াল! তুই যে আকাশ আজ দেখছিস,সে আকাশ মাঝে মাঝে এসে আমিও দেখি। আমি যখন উপরের দিকে তাকাই মনে হয়,বাবা যেনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি যেনো স্পষ্ট শুনতে পাই বাবা বলছে- মা,ছোটু,রিমি,রিপা,তোর মা সবার দায়িত্ব তোর উপর দিয়ে স্বার্থপরের মতো চলে এসেছি। তুই পারছিস তো?

বলতে বলতে ওড়নার কোণ টেনে চোখের জল মুছে নেয় রিয়া।

-যদি এমন কোনো ছেলে তোর জন্য ঠিক করি-যে এই তুইকে বুঝবে,তুই রাজি হবি তো! ছোটোকালে তোকে অনেক জ্বালিয়েছি। আজ আরেকবার আমার অত্যাচার সহ্য কর্ প্লিজ!

একটু সময় নিয়ে রিয়া সম্মতিতে মাথা নাড়ে শুধু।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়ালো পিয়ালের যাওয়ার দিনে। ব্যস্ততার শেষ নেই রিয়ার। কয়েক রকমের আচারের বয়াম,শোলমাছের ভুনা ভরা বাক্স, কাপড়- চোপড়ে ভরে উঠতে লাগলো পিয়ালের লাগেজ। ঘরভাড়ার যে টাকায় এই ঘর চলে তার অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে জানে পিয়াল। পরের মাসে এই খরচ টানতে কষ্ট হয়ে যাবে রিয়ার। আর নিষেধ করলে মনে কষ্ট পাবে।

-আর কী কী বাকী আছে?

লাগেজে জিনিসগুলো নিপুণ হাতে গুছিয়ে রাখতে রাখতে হেসে বলে,

-জিয়ানা আর তোর বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু পাঠালাম।

-আমরা রজনীগন্ধার গোছা নিয়ে তোকে ধন্যবাদ জানাতে আসবো।

এত ফুল থাকতে রজনীগন্ধা কেনো?

কারণ… নাহ! এখন বলবো না।সেদিন বলবো। বলেই হেসে দেয় পিয়াল। সে হাসি ছুঁয়ে দেয় রিয়ার ঠোঁটও।

এই হাসিটাই সেদিন পিয়ালের বুকে যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ সুঁই ফুটিয়েছিল। রিয়াকে দেখেই হৃৎপিণ্ডটা যেনো লাফিয়ে ওঠলো। এই রিয়া কী সেই রিয়া! পিয়াল কল্পনাও করেনি-একজন মানুষের চলে যাওয়া কতগুলো জীবনকে ভেঙে চুরে দেয়। পিয়ালের বউ বাঙালি মেয়ে জিয়ানা। আছে পুতুলের মতো মেয়ে দুটো। ভালো চাকরি। আরাম আয়েশের জীবনে অভ্যস্ত পিয়াল ভুলেই গিয়েছিল টানাপোড়েন নামে একটি শব্দ আছে।

চলে যাবার সময় যত ঘনিয়ে আসছে,পিয়ালের মন পাথরের মতো ভারী হয়ে আসছে। রিপোর্টিং পাঁচটায়।

-খুব শীঘ্রি আবার আসছি রিয়া। এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে রিয়ার হাত ধরে বলে পিয়াল।

কথাপ্রসঙ্গে রিয়ার চোখ ছলোছলো করে উঠলেও এই প্রথম পিয়াল দেখলো ফোটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়া।

এবার গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই একবার হলেও পিয়ালের ফোন এসেছে। আজও সন্ধ্যায় ফোনের রিং বাজতেই রিসিভ করে রিয়া।

-তোর কথা জীবনকে বলেছিলাম। আমার এক বন্ধু। সে তো দারুণ উচ্ছ্বসিত তোর কথা শুনে। ছবিও দেখালাম। বললো কাল জানাবে। রজনীগন্ধা কোথায় একদম ফ্রেশ পাওয়া যায় রে?

-তুই তো উঠে পড়ে লেগেছিস আমাকে বিয়ে দিতে। রিয়ার হাসির শব্দ ভেসে আসে ফোনে।

– ভুল বলেছিস। তোকে একমুঠো রোদ্দুর দেবো। রিয়া? তুই এখানে চলে এলে বেশ মজা হবে! আমরা আবার সেই শিউলি,কামিনীর দিন,মাঠে ছুটোছুটি করার দিনে ফিরে যাবো। এবার দল আরো ভারী হবে। জিয়ানা থাকবে, আমার পুতুল দুটো থাকবে। বেশ মজা হবে তাই না রে? কাল আবার জম্পেস একটি খবর নিয়ে আবার কথা হবে। রাখি এখন।

ফোন কেটে যাওয়ার পরও হাসির রেশ লেগে থাকে রিয়ার মুখে। ছোট্ট ঘরটাতে একটি নিরব আনন্দ ছেয়ে যায়।ছোটু,রিমি,রিপা কানাকানি করে। বড়াপুর বিয়ে হবে,বিদেশ যাবে,কী আনন্দ! মায়ের অসুস্থ মুখে খুশি ঝিলিক দেয়।

পরদিন ফোন আসে বেশ দেরিতে।

নিষ্প্রভ কণ্ঠে পিয়াল জানতে চায়,

-সুন্দরের মানে কী রে রিয়া? মানুষ কেন ফর্সা রঙ,সুন্দর চেহারায় রুপ খোঁজে? প্রেম ভালোবাসা সব তো মনেই থাকে। তবুও কেন মানুষ উপরের সুন্দরকে বেশী গুরুত্ব দেয়? তোকে আবার কষ্ট দিলাম।

– আমি জানতাম পিয়াল। তুই মন খারাপ করছিস কেন? এই যে আমার সংসার?  আমার মা,ছোটু,রিমি,রিপা? আমি ভালো আছি পিয়াল।

-রিয়া?…..ওপাশে নিস্তব্ধতা।

-মা’কে ইনসুলিন দেয়া হয় নি এখনো পিয়াল। রাখি?  ভালো থাকিস…

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, মাস্টারমাইন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল(ইংরেজি মাধ্যম), চট্টগ্রাম।       

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: