শাহ সুহেল আহমদ
‘কামরান ভাই’ বললে আর কোনো বিশেষণ যার পেছনে প্রয়োজন নেই তিনিই বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। খুব কাছ থেকে দেখা। নানা বিষয়ে কথা বলা। বোশেখের ঝড়ের মতো করে হঠাৎ করেই যেন সব শেষ হয়ে গেল। নিভে গেল সিলেটের নক্ষত্র জনতার কামরান গণমানুষের কামরান।
পেশাগত কারণে অনেক নিউজ-ই কামরান ভাইর বিরুদ্ধে গেছে, কোনো টু শব্দটি পর্যন্ত করেন নি। সাংবাদিকতা শুরুর দিকে নাগরিক নিউজ বেশি করেছি। ফলে সবসময়ই কামরান ভাইয়ের সাথে একটা যোগাযোগ ছিল। বড় কোনো বিষয় হলে অফিসে ডেকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। অনেক ছোটখোটো বিষয় নিয়েও কামরান ভাইর সাথে আলাপ হয়েছে অনেক। কখনও বিরক্তবোধ করেছেন বলে মনে হয় না। এটি তার অনেক ভাল গুণের একটি।
কামরান ভাইর সাথে অনেক স্মৃতি। সবসময়ই তিনি স্নেহের সুরে কথা বলতেন। তখন আমরা স্থানীয় সরকার সাংবাদিক ফোরাম সিলেট বিভাগীয় কমিটি গঠন করেছি মাত্র। সভাপতি সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক লিয়াকত শাহ ফরিদী ভাই আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে। এ সংগঠনটি মূলত ম্যাস্ লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)’র তত্ত্বাবধানে এবং অর্থায়ন করতো সুইস সংস্থা এসডিসি।
কমিটি গঠনের কিছুদিন পর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করতে আমাদের একটি সেমিনার করার সিদ্ধান্ত হয়। তারিখ নির্ধারণের পর প্রধান অতিথি কামরান ভাইকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত করানোর দায়িত্ব দেয়া হয় আমার উপর। সাধারণত সিলেটে কামরান ভাইকে কোথাও উপস্থিত করানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আমি যখন কামরান ভাইর সামনে গিয়ে সেমিনারের বিষয়ে বললাম, তখন তিনি নিজের ডায়রি খোলে আমাদের নির্ধাতির তারিখে ঢাকায় দুদিন ব্যাপী কী একটা প্রোগ্রামে এটেন্ড করার নোট দেখালেন। আমাদের প্রোগ্রামটাও দিবস কেন্দ্রীক, তারিখ পরিবর্তন করা যাবে না। আর ঢাকার প্রোগ্রামটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন বললাম- আমাদের প্রোগ্রামে ঢাকা থেকে অতিথি আসবেন। তারাও জানেন, আপনাকে আমরা প্রধান অতিথি করেছি। সব শোনে আমার সামনেই তিনি ঢাকায় কল দিলেন। তাদের বললেন- আমি অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন এসে যোগ
দেব। তাদের সাথে ফোন শেষ করে বললেন- ‘আমি তোমার প্রোগ্রামে থাকছি।’
কামরান ভাই মেয়র থাকাকালীন সময়ে অনেক মধ্যরাতেও তিনি অফিসে থাকতেন। তখন বেশির ভাগই রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাঁর অফিসে ভিড় করতেন। একদিনের ঘটনা। রাত তখন অনুমানিক ১১/১২টার মতো হবে। আমি অফিস শেষ করে বাড়ি যাব। রওয়ানা দিয়ে বন্দরবাজার আসতেই ঝুম বৃষ্টি। দৌঁড়ে গিয়ে কুদরত উল্লাহ গেইটের নিচে দাঁড়িয়েছি। এ সময়টাতে কামরান ভাই কোথা থেকে প্রোগ্রাম শেষ করে আবার সিটি করপোরেশনে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। বৃষ্টিতে আমার ভিজে যাওয়া তার চোখ এড়িয়ে যায় নি। তিনি গাড়ি থামিয়ে বললেন- সুহেল কোথায় যাবে? ‘হফার’ বলতেই বললেন গাড়িতে ওঠো। তিনি সিসিকের নিচে নেমে ড্রাইভারকে বললনে, ‘সুহেলরে হফার দিয়া গাড়ি মিলাইয়া দিয়া আইও’।
এমন একজন সজ্জন কামরান ভাইর সাথেও আমি শেষ অবদি সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি নি। এটা আমার ব্যর্ততাই হয়তো। ২০১৩ সালে যে সিটি করপোরেশ নির্বাচনে কামরান ভাই হেরে যান, সে নির্বাচনের আগে আমার বেশ কটি নিউজ কামরান ভাইর বিপক্ষে যায়। এমন কি আমাদের পত্রিকা থেকে নির্বাহী সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী দীপু ভাইয়ের তত্ত্ববধানে পুরো নগরব্যাপী একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপ কার্যক্রম পরিচালনায় আমরা পত্রিকার সকল সাংবাদিকসহ শাবি, এমসিসহ সিলেটের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয়।
ওই জরিপের নিউজ প্রকাশিত হয় নির্বাচনে মাত্র কয়েকদিন আগে। কাকতালীয়ভাবে আমাদের জরিপের নিউজের সাথে নির্বাচনের ফলাফল প্রায় শতভাগের কাছাকাছি মিলে যায়। ওই জরিপের মূল নিউজটি ছিল আমার বাই নেমে। শোনেছি এই নিউজের পর কামরান ভাই খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আমাকে সরাসরি কিছু বলেন নি। কিন্তু সিলেটের কয়েকজন সাংবাদিক ফোন করে তার ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি আমাকে জানিয়েছিলেন।
নির্বাচনে তিনি হেরে গেলেন। এর দুদিন পরেই আমি তাঁর বাসায় গিয়ে সরাসরি আবর তাঁর ইন্টারভিউ করেছি। বলেছিলেন- সুহেল আমি মানুষের মেয়র ছিলাম। সিসিকের মেয়র না থাকলেও মানুষের মেয়র হয়ে থাকবো আজীবন। ফিরে এসে এটিই আমি নিউজের মূল শিরোনাম করে তার ইন্টারভিউটা ছেপেছিলাম।
এ রকম শত সহস্র স্মৃতিঘেরা কামরান ভাইর সাথে। দুদিন থেকে ভাবতেই পারছিনা, আমাদের কামরান ভাই, জনতার কামরান ভাই আর নেই। কীভাবেই বা মানা যায়! বলুন?
একজন জনপ্রতিনিধির দরজা সবার জন্য সমানভাবেই খোলা থাকার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটি অনেকেই করতে পারেন না। এই জায়গাতে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন ব্যতিক্রম। দীর্ঘ সময় তিনি সিলেটের মেয়র ছিলেন। ওই সময়টাতে তার অফিসে গিয়ে কেউ কথা না বলে ফিরেছে, এমন নজির খুব কম।
কামরান ভাই ফিরবেন না, এটা সত্য। কিন্তু তাঁর করে যাওয়া কাজ তাঁকে মানবহৃদয়ে সজীব রাখবে কাল মহাকাল ধরে।
লেখকঃ সম্পাদক- বাংলা টেলিগ্রাম।