আজ ১৪ জুলাই। ফ্রান্সের ঐতিহাসিক বাস্তিল ডে তথা ফরাসি বিপ্লবের দিন।
সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব ছিল ফরাসি বিপ্লবের মূল স্লোগান। ১৭৮৯-১৭৯৯ সময়কাল ছিল ফ্রান্সের ইতিহাসে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি দুর্যোগপূর্ণ অথচ পরিবর্তনের দশক। এসময় পূর্বেকার পূর্ণ রাজতান্ত্রিক সরকার কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে এবং নতুনভাবে জনগণের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিলুপ্ত হয় ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা অভিজাত, ক্যাথলিক সম্প্রদায় এবং সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার। এ বিপ্লব ফ্রান্সের গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শে দেশের জনগণসহ সারাবিশ্বকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আজও সারা বিশ্বময় শোষণের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লব একটি জাগ্রত চেতনা।
ফরাসি বিপ্লবের কারণ
একটি বিপ্লব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা কারণে সংগঠিত হতে পারেনা। বরং একটি নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়। ফরাসী বিপ্লবও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তৎকালীন ফ্রান্সের অন্যতম সমস্যা ছিল খাদ্যসংকট তথা অর্থনৈতিক সংকট। উপরন্তু বিপ্লবের অল্প কিছুপূর্বে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। ফলে বৈদেশিক সাহায্য থেকেও বঞ্চিত এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ফ্রান্সের রাজতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
অন্যদিকে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই অনেকগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই আমেরিকান বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের অধীনস্ত উপনিবেশসমূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রচুর সহযোগিতা প্রদান করেন। যদিও দেশটির অভ্যন্তরীণ অবস্থা ছিল খুবই নাজুক।
বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে ইতিহাসে সাক্ষ্য রয়েছে যে, রাজা চতুর্দশ লুই ছিলেন দৃঢ়চেতা ও প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার মৃত্যুর পর পুত্র পঞ্চদশ লুই ও প্রপৌত্র ষোড়শ লুই তার স্ত্রী ম্যারি এন্টোনয়েট এবং রাজ্যের এলিট শ্রেণীর উচ্চাবিলাসী ও অপরিণামদর্শী মানসিকতাও ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ। বেকারত্বের উচ্চহার, খাদ্যসংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে জনজীবন ক্রমান্বয়ে জটিল হতে থাকে। কর আদায়ের ক্ষেত্রে তৎকালীন ফ্রান্সের অভিজাত সম্প্রদায় ও যাজক শ্রেণী দেশের সিংহভাগ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করলেও এরা সর্বপ্রকার করভার হতে মুক্ত ছিল। পক্ষান্তরে অধিকার বঞ্চিত তৃতীয় সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের সকল প্রকার করভার বহন করতে হত। বিনা পারিশ্রমিক বা নামেমাত্র পারিশ্রমিকে শ্রম মজুরদের খাটানো হত। তাছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় শ্রমিকরা থাকত বেকার। কৃষকদের জমিদার কর, চার্চ কর, রাজার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর পরিশোধ করার পর অবশিষ্ট উৎপাদন দিয়ে জীবন নির্বাহ ছিল অনেকাংশে অসম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে পেষাজীবী কৃষককুলসহ তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকদের মনে ক্ষোভ ক্রমেই পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়।
ফরাসি বিপ্লবের পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণও বিদ্যমান। বিপ্লবপূর্ব জাতীয় প্রতিনিধি সভার নির্বাচনে যাজক সম্প্রদায় এবং দ্বিতীয় শ্রেণী ও তৃতীয় শ্রেণীর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত ভোট ছিল সমান। স্বার্থের খাতিরে প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায় সর্বদাই সম্মিলিতভাবে কাজ করত। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ভোটের দিক থেকে তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল সংখ্যালঘু। এ অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে তৃতীয় সম্প্রদায় প্রত্যেক সদস্যের একটি ভোটের দাবি জানায়। যাজক সম্প্রদায়, অভিজাত সম্প্রদায় এবং রাজা এ দাবির বিরোধিতা করলে শ্রেণীসংঘাত শুরু হয় এবং রাজা দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে তৃতীয় সম্প্রদায় অধিকার আদায়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
সর্বোপরি উপরোক্ত সমস্যাসমূহ মোকাবেলায় রাজা ষোড়শ লুই এবং তার উপদেষ্টাদের ব্যর্থতা, রানীর বিলাসিতা ও রাজার ওপর তার অত্যাধিক প্রভাব ও হটকারি সিদ্ধান্ত ফরাসি বিপ্লবের মূল অনূঘটক হিসেবে কাজ করে।
বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্স
ফরাসি বিপ্লবের পূর্বেকার অবস্থাকে তিনভাবে দেখানো যেতে পারে।
১. আর্থিক দৈন্যদশা
২. রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
৩. তৃতীয় সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের শপথ।
এ দিকগুলোর বর্ণনা ইতোমধ্যেই আমরা আলোচনা করেছি। মূলত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অসাম্য, অনাচারপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শোষিত ও নিপীড়িত ফরাসি জনগণের মনে যে বিক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছিল তা ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।
ফরাসি বিপ্লব ও এর দর্শন
ফরাসি বিপ্লব সংঘঠিত হবার ক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। রুশো, ভলটেয়ার, মন্টেস্কুদের হৃদয়স্পর্শী বক্তব্যগুলো ঐ সময় সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে লক্ষ লক্ষ শোষিত ও নিপীড়িত নর-নারীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে’র স্লোগান। এসব দার্শনিকরা বলেন, ‘রাজা জনসাধারণের মতানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা না করলে তাকে পদচ্যুত করার অধিকার জনগণের রয়েছে। আবার রুশোর দর্শনে বলা হয়, মানুষ স্বাধীন সত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’। এ সমস্ত বাণীগুলো ফরাসি বিপ্লবের দর্শন হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। অনুপ্রেরণা দিয়েছে বিপ্লবী জনতাকে।
ফরাসি বিপ্লবের ধারাবাহিকতা
১৭৮৯-১৭৯৯ সময়ের মধ্যে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী নিম্নে আলোচনা করা হচ্ছে-
ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি
১৭ জুন ১৭৮৯ তৃতীয় সম্প্রদায়ের জাতীয় পরিষদ প্রতিনিধিরা তিন সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রত্যেকের এক ভোটের ভিত্তিতে জাতীয়সভা গঠনের প্রস্তাব দিলে রাজা কোন সন্তোষজনক জবাব দেননি। ফলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ জাতীয়সভা গঠন করে কর ধার্যের অধিকার নিজেদের হাতে নেয়ার মাধ্যমে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন। প্রকৃতপক্ষে এ সময় হতে ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়।
টেনিস কোর্টের শপথ
তৃতীয় সম্প্রদায় কর্তৃক গঠিত জাতীয় পরিষদ রাজা ভেঙ্গে দেন এবং সামান্য অজুহাতের মাধ্যমে জাতীয় সভাগৃহ বন্ধ করে দেন। ফলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ নিকটবর্তী টেনিস কোর্টে জমায়েত হন এবং নিজেদের চূড়ান্ত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ করেন ১৭৮৯ সালের ২০ জুন।
এলিট শ্রেণীর যোগদান
তৃতীয় সম্প্রদায়ের আন্দোলনে একমত পোষণ করে ১৭৮৯ সালের ২৭ জুন ৪৭ জন অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।
সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ
১১ জুলাই ১৭৮৯ জনপ্রিয় মন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করা হলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। কেননা নেকার তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন।
সামরিক বাহিনী গঠন ও অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বিদ্রোহী জনতা “নাগরিক গার্ড” নামক একটি সামরিক বাহিনী গঠন করে। এ বাহিনী খুব শিগগিরই অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে অস্ত্রের মজুদ নিশ্চিত করে।
বাস্তিল দুর্গের পতন
১৭৮৯ সালের ১১ জুলাই জনপ্রিয় মন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করা হলে তৃতীয় সম্প্রদায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। ফলে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা এবং নিজেদের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তৃতীয় সম্প্রদায় “নাগরিক গার্ড” নামক একটি সামরিক বাহিনী গঠন করে। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় বাস্তিল দুর্গের দিকে নজর দেয়। এ দুর্গটি ছিল ঐতিহ্যগতভাবে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের প্রতীক। এ দুর্গে রাজবন্দী এবং বিপুল সংখ্যক রাজকীয় সৈন্য অবস্থান করতো। কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর বিকেলে বিদ্রোহীরা এ দুর্গ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, এসময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৯৮ জন বিদ্রোহী এবং ৮ জন রাজকীয় সিপাহী নিহত হয়। আধুনিক ফ্রান্সের জনগণ এ দিনটিকে প্রতিবছর জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে।
ভার্সালিসে নারী সম্মেলন
১৭৮৯ সালের ১-৫ অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় ৭,০০০ নারী ভার্সালিসে বিভিন্ন দাবিতে সম্মেলন করে। এ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা বিদ্রোহীদের আন্দোলনের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে। ফলে বিপ্লবের গতি অনেক বেগবান হয় এবং ৬ অক্টোবর রাজা ও রাজপরিবার ভার্সালিস হতে নিরাপত্তার সাথে প্যারিসে প্রস্থান করেন।
যাজকদের ক্ষমতার বিলুপ্তি
১৭৯০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় নিজেদের অধিকার ও সুযোগ সুবিধা বর্জন করে। এর ফলে নিপীড়নমূলক করপ্রথা এবং সামন্ততন্ত্র বাতিল হয়।
রাজার পতন
১৭৮৯ সালের ৫ অক্টোবর রাজা অনেকটা বন্দী অবস্থায় উপনীত হন। ক্রমেই তার ক্ষমতা শূন্যের কোঠায় নেমে আসেন। কয়েক বছর পর ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি শত সহস্র জনতার সম্মুখে রাজা ষোড়শ লুইসকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় আয়োজিত ভোটে ৩৬১ জন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং ২৮৮ জন বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে ১৬ অক্টোবর রানীর ক্ষেত্রেও একই শাস্তি কার্যকর করা হয়।
বিপ্লবের সফল পরিসমাপ্তি
প্রায় এক দশক সময় ধরে চলা ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল অবস্থা অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ ভাগে এসে স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল হয়। ১৭৯৯ সালের দিকে ফ্রান্সের বিপ্লব তথা ফরাসি বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সফলতার চেতনাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানেও ফ্রান্স একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
লেখক :এইচ এম দিদার: