শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Sex Cams

বিশ্ববাজারের সুবিধা পাচ্ছেন না ভোক্তারা




স্টাফ রিপোর্টার,
655
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমছে না। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় তেলের দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে কমেনি। বরং নানা অজুহাতে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ রমজানের ঈদের পর পাম অয়েল ও সুপার পামের দাম বেড়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। টানা বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণ দেখিয়ে এ দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। অথচ এ তেলের দাম হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে সামান্য কমিয়ে আবার থেমে যায়। যা বিশ্ববাজারের তুলনায় মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতি এক মাস অন্তর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থা প্রকাশিত সূচকে দেখা যায়, ভোজ্য তেলের মূল্যসূচক গত মাসে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কমে নেমেছে ১৮১ দশমিক ১ পয়েন্টে। জুনে তেলের সূচক ছিল ১৮৮ দশমিক ৮ পয়েন্ট, মে মাসে ১৯৫ দশমিক ৩ পয়েন্ট ও এপ্রিলে ১৯৯ পয়েন্ট। তাদের হিসাবে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দরপতনও অব্যাহত রয়েছে। তবে এসবের ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এদিকে গত মার্চ মাসে বিশ্ববাজারে প্রতি মণ ভোজ্য তেল ৩৯০০ থেকে ১০০০ টাকা কমে ২৯০০ টাকায় নেমে এসেছে। এতে মানভেদে প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দর হওয়ার কথা সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসেবে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ও একাংশ ব্যবসায়ী নেতা মনে করেন, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম হওয়া উচিত প্রতি লিটার ৮০ টাকা। লুজ পাম, সুপার ও সয়াবিন হতে পারে ৫০ থেকে ৬৬ টাকা। অথচ বাজারে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। আর সব ধরনের লুজ তেল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া খুচরা পর্যায়ে লিটারে আরও ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি নিচ্ছে। গলি পথের দোকানে সব ধরনের লুজ তেল ৯০ থেকে ১০০ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। এতে ব্যবসায়ী ও ট্যারিফ কমিশনের দেয়া মতও উপেক্ষিত হচ্ছে। যেখানে প্রায় ২০ থেকে ৩০ টাকা টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছেন সয়াবিন তেল ব্যবসায়ীরা। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, শুধু গত পাঁচ মাসে বিশ্ববাজারে প্রতি মণ ভোজ্য তেলের দাম কমেছে ১০০০ টাকা। এর পরের মাসগুলোতেও তেলের সূচক নিম্নমুখী। পাইকারি বাজারে কিছুটা কমলেও মিল মালিক ও খুচরা পর্যায়ে তেলের দাম কমানো হচ্ছে না। বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব বাণিজ্যমন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও টিসিবির। কিন্তু এ সব প্রতিষ্ঠান নিশ্চুপ। তিনি বলেন, পরিশোধন, ভ্যাটসহ সার্বিক খরচ বাদ দিয়ে বর্তমানে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম হতে পারে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। অথচ এ তেলের দাম রাখা হচ্ছে ১০০ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে সব ধরনের লুজ তেলের দাম হতে পারে ৫০ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু নেয়া হচ্ছে অনেক বেশি। কেউ কেউ মনে করেন, ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। একাধিক ডিলারও বলেছেন, তেলের দাম অন্যায্যভাবে রাখা হচ্ছে। অবশ্য মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীরা তা মনে করেন না। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৩৬ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে কমেছে মাত্র ৮ শতাংশ। অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে কমেছে ৯ শতাংশ। দেশের বাজারে কমেছে ৭ শতাংশ। ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রতি মণ সয়াবিন তেলের সব খরচসহ আমদানি মূল্য (সিঅ্যান্ডএফ) ছিল ৯৪ হাজার ৬৪৩ টাকা (১১৯৮ ডলার)। ২০১৪ সালের একই সময়ে ৬০ হাজার ৫৪১ টাকায় (৭৬৬ ডলার) আমদানি হয়েছে। এক বছরে প্রতি টনে দাম কমেছে ৩৪ হাজার ১০২ টাকা। এর ফলে প্রতি লিটারে কমেছে ৩৪ টাকা। চলতি বছরের শুরুতে তা আরও কমে এসেছে। কিন্তু তার প্রতিফলন বাস্তবে নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, অন্যায্যভাবে ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের দাম রাখলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ভোজ্যতেলের বাজার। তারা মার্কেট ভাগ করে নিয়েছে। এখানে কোন প্রতিযোগিতা নেই। তারা যেভাবে দেবে ওভাবেই গ্রহণ করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি হওয়ায় তাদেরকে কিছু বলারও সুযোগ নেই। অতিরিক্ত মুনাফা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল মিলছে না। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দর বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে দেশেও দর বেড়ে যায়। তিনি বলেন, এ জন্য টিসিবির বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব খাদ্যপণ্য টিসিবির মাধ্যমে আমদানি করে কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একই সঙ্গে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিলে অতি মুনাফার প্রবণতা কমবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের মহাপরিচালক আবুল হোসেন বলেন, সয়াবিন তেলে দাম বেশি নিলে কিছু করার নেই। কারণ দাম কত রাখবে না রাখবে সে বিষয়টি ভোক্তা অধিকারের আওতার বাইরে। নিজের সীমানা চিত্র বর্ণনায় তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী পণ্যের গায়ে বিএসটিআইয়ের সিল, মূল্য ও মেয়াদ আছে কিনা তা দেখার অধিকার আছে। কিন্তু এর বাইরে কিছু করার ক্ষমতা নেই ভোক্তার। কারণ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ব্যবসায়ী নিজেই করে। ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি লিটার অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি ব্যয় প্রায় ৫৭ টাকা। এর সঙ্গে পরিশোধনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রতি লিটারে ১৬ টাকা এবং বোতলজাত করতে খরচ ৭ টাকা। এতে প্রতি লিটারে দাম হওয়া উচিত ৮০ টাকা। ব্যবসায়ীরা প্রতি লিটারে মুনাফা করছে প্রায় ২০ টাকা। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে ভোজ্য তেলের ওপর আরোপিত করে কোন পরিবর্তন হয়নি। ভোজ্য তেলে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর টিসিবির তৈরি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। লুজ সয়াবিন, পাম ও সুপার পাম বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। ভোজ্য তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বর্তমানে যে দাম রাখা হচ্ছে তা যুক্তিসঙ্গত। দেশের শীর্ষ তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ। তীর ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তেল বোতলজাত করে গ্রুপটি। যোগাযোগ করা হলে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, মার্কেট থেকে তথ্য নেন। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। কয়েকজন ডিলারের দাবি, বিশ্ববাজারে যে হারে তেলের দাম কমেছে সে হারে দেশের বাজারে তেলের দাম ৬০ থেকে ৭৫ টাকা হওয়ার কথা। কোম্পানিরা দাম কমাচ্ছে না। আবার যে লুজ তেল ৫০ টাকার নিচে থাকার কথা সে লুজ তেল গলি পথে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা থেকে ১০০ টাকা। মূলত ঘাটে ঘাটে তেলের দাম বেড়ে ভোক্তা পর্যন্ত এসে ১০০ টাকায় ঠেকেছে। যা ন্যায্য দাম হলে ভোক্তা মাত্র ৫০ টাকায় ক্রয় করতে পারতো।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: