আফরোজা সোমা
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে
এক চিলতে উঠোন। সেখানে লাল ওড়নায় ঢাকা আফরোজার মরদেহ। বছর দশেকের এক রত্তি মেয়ে। কয়েকদিন ধরে অর্ধাহারে ছিল সে ও তার পরিবার। কিন্তু আধপেটা খেয়ে বাঁচার চালটুকুও আর জুটল না। শুরু হলো অনাহার। অভুক্ত মেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে কানড়বাকাটি করছিল। দরিদ্র বাবা। পেশায় তাঁতি। নিজেও অভুক্ত। কানড়বা থামাতে নিরুপায় পিতা মেয়েকে ধমক দেন। কিন্তু ধমকে তো ক্ষুধা মেটে না! তাই, ফাঁসিতে ঝুলে যায় অভিমানী আফরোজা।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌর এলাকার ঘটনা। ১১ এপ্রিলের কালের কণ্ঠ পত্রিকায় খবরটি রয়েছে। আফরোজা একা নয়। অভুক্ত, নিরনড়ব মানুষের আহাজারি উঠেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়। ভাতের কষ্টে আছে নিমড়বআয়ের মানুষ। দেবীর কাছে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ বলে বর মাগেন যে মা, তার সামনেই দুই নলা ভাতের অভাবে গলায় দড়ি দিচ্ছেন প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কড়াকড়ি। রোগের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে গৃহবন্দি থাকছে মানুষজন। এই অবস্থায় আয়-রোজগার হারিয়ে খাদ্য সংকটে পড়েছে কোটি মানুষ। ১০ এপ্রিল ডেইলি স্টারে প্রকাশিত খবরে লিখেছে, ‘দেশের চরম দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশ বেড়েছে ও ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই’। চলতি মাসেই বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক-এর এক গবেষণা থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। এই অবস্থায়, নিরনড়ব মানুষের মুখে যৎসামান্য খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টায় ত্রাণের চাল বরাদ্দ করেছে সরকার। কিন্তু সেই চাল চুরি করে নিজের আখের গোছানোর মচ্ছবে নেমেছে ‘চোরের দল’।
দুধে-ভাতে উৎপাত
কথায় আছে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। অভুক্ত মানুষের চালের বস্তাও হাপিস করে দিচ্ছে চোরারা। কয়েকটি পত্রিকা থেকে চোরামির কিছু নমুনা তুলে ধরছি। ৭ এপ্রিলের প্রকাশিত খবরে বিডিনিউজ লিখেছে, ‘জেলায় জেলায় সরকারি চাল চুরি, আ.লীগ নেতারাও আটক’। ১২ এপ্রিলের যুগান্তর বলছে, ‘পাঁচ জেলায় আরও ১৫৭৯ বস্তা জব্দ : থামছে না সরকারি চাল চুরি; আ’লীগ নেতা ও ইউপি সদস্যসহ আটক ৭’। ১২ এপ্রিলের ডেইলি স্টার জানাচ্ছে, ‘দেশ যখন করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় যুদ্ধ করতে ব্যস্ত, তখন কিছু জনপ্রতিনিধি ও ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) ব্যবসায়ী অসহায় মানুষ ও ওএমএস প্রকল্পের চাল চুরিতে ব্যস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন গত ১২ দিনে ২০টি উপজেলায় চাল চুরির অন্তত ২২টি ঘটনা প্রকাশ করেছে এবং ৫০ কেজির ২ হাজার ৮৩২ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১০ জনপ্রতিনিধিসহ ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’
এই চোরারা নতুন নয়। রিলিফের গম থেকে শুরু করে ত্রাণের চাল, বন্যার্তদের জন্য দেওয়া টিন, গরিব মানুষের জন্য দেওয়া ভিজিডি কার্ড, দুস্থ বৃদ্ধদের জন্য দেওয়া বয়স্কভাতা হেন বস্তু নেই যা তারা চুরি করে না। চোরাদের রগে রগে চিনেছিলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি বলেছিলেন: ‘এত রক্তের পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরী বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে’।
দেশ স্বাধীনের পর ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে নিরনড়ব মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু যখন দুনিয়া জুড়ে ভিখ মাগছেন তখনো নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিল চোরেরা। তাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘যেই দুখী মানুষ দিন ভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, তাদের পেটে খাবার নাই, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই, লক্ষ লক্ষ বেকার, পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে, কাগজ ছাড়া আমার জন্য কোনো কিছু রেখে যায় নাই, বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়। আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে লুটতরাজ করে খায়’।
বাংলাকে ঘুণের মতন ভেতর থেকে কেটে ফাঁপা করে দিচ্ছে ছোট-বড়-মাঝারি দুর্নীতিবাজরা। এই সত্য বাঙালির নেতা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই বলেছিলেন, দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করতে পারলে মানুষের দুঃখ অনেকাংশে দূর হবে। তাই, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই ঘোষণা করে তিনি বলেছিলেন: ‘বাংলার মাটি থেকে এই দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোর এই চোরাচালানকারীদের নির্মূল করতে হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও। বাংলার জনগণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো। আর না। অসহ্য হয়ে সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এই জন্য শহীদেরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। কয়েকটা চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বাইর করে দিয়ে আসে। জিনিসের দাম গুদাম করে মানুষকে না খাওয়াইয়া মারে। উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের। দেখি কতদূর তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি না ইমানদারের শক্তি বেশি? সেইটাই এখন প্রমাণ হয়ে যাবে’।
বাংলার জনগণ, প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী দুয়ারে কড়া নাড়ছে। বিজয়ের উৎসব পালন করতে আড়ম্বরের কমতি থাকবে না। কিন্তু সব আয়োজন, সব আড়ম্বর ব্যর্থ ও অসাড় হয়ে যাবে যদি না বাংলার বুক থেকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে নির্মূল করা যায়। দেশের আগাপাশতলা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। অফিস-আদালত-প্রশাসন-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-ব্যাংক কোথায় নেই দুর্নীতি! এমনকি ঘুষের টাকাকে প্রকাশ্যে ‘স্পিডমানি’ হিসেবে দেওয়া হয়েছে স্বীকৃতি।
করোনার এই বর্ণনাতীত সংকটকালেও চোরারা লুটপাটে ব্যস্ত। এই দশা একদিনে তৈরি হয়নি। এক-দুই-তিন করে সংকট পর্বতসম হয়েছে। চোরের দলের সংখ্যা এখন এতই বেশি যে, ঠক বাছতে গা উজাড়। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। কিন্তু এই দশা মোচন করা বাংলাদেশের কোনো একক শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। চোরাদের দল বড়। তাদের নেটওয়ার্ক সর্বত্র বিস্তৃত। করোনার সংকট আজ বাদে কাল বা পরশু কেটে যাবে। যাবেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু লুটেরা, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও মুনাফাখোর নামড়বী ভাইরাসদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। গত ৫০ বছরে সমাজের শিরায় শিরায় তারা সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এই সংক্রমণ দূর করাই এখন বাংলার মানুষের প্রধান কর্তব্য। দুর্নীতি হটাতে পারলে সুশাসন আপনা-আপনিই আসবে।
চোর-লুটেরা-মুনাফাখোর-ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের ঠেকানোর জন্য এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু একটি তরিকা উল্লেখ করেছিলেন। সেই ফর্মুলায় তিনি দু’টো পক্ষকে দুই ধরনের কাজের কথা বলেছেন। একপক্ষে জনগণ। জনগণকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুর্বার সামাজিক আন্দোলনের জন্য ছাত্র, যুবা ও বুদ্ধিজীবীদের ডাক দিয়েছেন। দুর্নীতিবাজদের বয়কট করতে বলেছেন। অন্যপক্ষ হচ্ছে, সরকার। দেশের প্রধান হিসেবে তিনি জনগণকে অভয় দিয়ে বলেছেন ‘ভয় নাই। কোনো ভয় নাই। আমি আছি’। জনগণের সহায়তায় দুর্নীতিবাজদের ধরে চোরাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন : ‘আইন করে দুর্নীতিবাজ দমন করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া। দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে? আইন চালাব। ক্ষমা করব না। যাকে পাব ছাড়ব না। একটা কথা আপনাদের মনে রাখতে হবে। জনগণের এমন গণআন্দোলন করতে হবে এমন আন্দোলন করতে হবে, যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চালান দেয় তারে সামাজিক বয়কট করতে হবে। […] দেখাতে হবে, ওই চোর, ওই ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার। ভয় নাই। কোনো ভয় নাই। আমি আছি। […] কিন্তু আপনাদের গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে হবে। পারে কে? ছাত্র ভাইরা পারে। পারে কে? যুবক ভাইরা পারে। পারে কে? বুদ্ধিজীবী পারে। পারে কে? জনগণ পারে’।
জনতা ও নেতা : যার যা কাজ
আমাদের হতাশার শেষ নেই। পত্রিকার পাতাভরা দুর্নীতির খবর। বালিশ-পর্দা-বই থেকে শুরু করে রডের বদলে বাঁশ, ব্রিজের বদলে পিলার, বিদ্যুতের বদলে খাম্বা, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত সাজিয়ে হাসপাতালের আইসিইউয়ে রেখে দেওয়া, পুকুর কাটা শিখতে বিদেশ যাওয়া, ব্যাংক লোপাট করে দেওয়ার মতন লাখ লাখ উদাহরণ আছে। আপাতার্থে প্রত্যেকটি অপরাধ ও দুর্নীতি একেকটি ভিনড়ব ঘটনা। কিন্তু আদতে এগুলো কোনোটাই কোনোটা থেকে বিচ্ছিনড়ব নয়। রসুনের সব কোয়ার গোড়া যেমন একটা তেমনি সব গলদের গোড়ায় একটা সম্পর্ক আছে। জবাবদিহিহীন, সুশাসনের অভাবে ভুগতে থাকা ব্যবস্থায় এগুলো ঘটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি ঘটনার বিচার হওয়া দরকার। ধামাচাপা চলবে না। ছাড় দেওয়া চলবে না। শাস্তি না হলে, বিচার না হলে অপরাধীর বাড় বাড়ে। তাই, বঙ্গবন্ধু ‘আইন চালানোর’ কথা বলেছিলেন।
অন্য দিকে, এটিও সত্য যে, ‘শয়তানের দল বড়’। সব শয়তান এক হয়ে সৎ পুলিশের চাকরি খেয়ে দেওয়ার ঘটনা বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচাতেই উল্লেখ রয়েছে। চোরেরা যদি দেখে তাদের খাওয়া-খাওয়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন সাধুকে হটাতে চোরে-চোরে মাসতুতো ভাইয়েরা সাময়িকভাবে একাট্টা হয়ে যায়। এক্ষেত্রেই জনগণের সোচ্চার ভূমিকা দরকার।
ভালো মানুষের নীরবতা সমাজের বিপদকে বাড়িয়ে দেয়। তাই, নিজে একা ভালো মানুষ হলেই দায়মুক্তি ঘটে না। চাল চোরদের মুখোশ খুলে দিতে যেমন জনগণের সক্রিয় ভূমিকা দরকার তেমনি দেশের টাকা লুটেপুটে, দেশের ব্যাংককে দেউলিয়া বানিয়ে যারা বিদেশে টাকা পাচার করে, দেশেও যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায় তাদের বিরুদ্ধেও জনগণের সজাগ থাকা দরকার। জনগণ ঘুমিয়ে থাকলে ঝিমিয়ে পড়া কর্তৃপক্ষকে একা দোষ দেওয়া যায় না।
লেখক
কবি ও সহকারী অধ্যাপক, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ