বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবিকার সন্ধানে গ্রামে ফেরা




ড. মো. ফখরুল ইসলাম

কোরবানি ঈদের এখনও অন্তত তিন সপ্তাহ দেরি। সাধারণত কোনো ঈদের এতদিন আগে শহরের মানুষ গ্রামের বাড়ি পানে ছুটে চলে না। কিন্তু এবারের ঈদে মানুষ রাজধানীসহ বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে।

এবার ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নয়; বরং নব্য বেকারত্ব ও করোনার আতঙ্কে বিচলিত ও হতাশ হয়ে নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে এবং নতুন জীবিকা খুঁজতে গ্রামে ফিরছে মানুষ। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ করে বেকারের সংখ্য এত বেশি হয়েছে যে, প্রতিটি অঙ্গরাজ্য নতুন বেকারদের বড় তালিকা অনুযায়ী ভাতা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে।

প্রবাসী চাকরিজীবীরা করোনার আতঙ্কে বিভিন্ন দেশ থেকে নিজ নিজ কর্মস্থল ছেড়ে নিজেদের দেশে পাড়ি জমানো শুরু করেছেন সেই দু’মাস আগে থেকে। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ অনেক দেশের কুটনীতিক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, সাধারণ কর্মী চাটার্ড বিমান ভাড়া করে দলে দলে নিজেদের দেশে চলে গেছেন।

বিদেশ থেকে আমাদের দেশেও বহু মানুষ ফিরে এসেছেন। শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক। হাজার হাজার নির্মাণ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন। চাটার্ড বিমানে তাদের লাশ দেশে আনা হয়েছে।

জুন মাসে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে রেকর্ড পরিমাণ। এর জন্য হঠাৎ করে জুনের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। আগামী দু’মাস আরও বেশি পরিমাণে রেমিটেন্স দেশে আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হল, করোনার কারণে আমদানি ব্যয় কমে যাওয়া এবং করোনাতঙ্কে প্রবাসীদের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেয়া।

ভয়ানক করোনার সংক্রমণের শিকার হয়ে প্রবাসীরা বিদেশে জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। প্রবাসী শ্রমিকদের বাসস্থান ও জীবনযাপন করার পরিবেশ চরম অস্বাস্থ্যকর। গ্রিস, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা খুব খারাপ ও মানবেতর জীবনযাপন করেন। এক কক্ষে তিন-চারতলা বেডের মধ্যে মই দিয়ে উঠে ১০-১২ জন শ্রমিককে গাদাগাদি করে রাত্রিযাপন করতে হয়।

টয়লেট, রান্না-খাওয়ার অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় সেসব দেশে বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের হার অনেক বেশি। শুধু সিঙ্গাপুরেই ১৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

দেশে করোনায় ২ হাজারের কিছু বেশি মানুষ মারা গেলেও বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশিদের মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। ১৯ দেশে ১ হাজার ৩৮০ জন বাংলাদেশি করোনায় মারা গেছেন। এছাড়া শুধু শ্রমিক নয়, ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক বাংলাদেশি চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও বরেণ্য ব্যক্তিও মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। সৌদি আরবে পাঁচ চিকিৎসকসহ ৫২১ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন।

সৌদি প্রবাসী ৩ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি দেশে ফেরার জন্য আবেদন করেছেন। ব্রিটেনে ৩০৫ জন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৭২ জন বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ কারণে প্রবাসীদের মধ্যে হতাশা জন্ম নিয়েছে। ফলে যার যা সঞ্চয় আছে তা দেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন। এই বৈদেশিক অর্থ দিয়ে দেশের মাটিতে কিছু একটা করার আশা তাদের মধ্যে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দু-এক মাস দেশে বেশি রেমিটেন্স আসার পর এর পরের অবস্থা খুব খারাপ হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই প্রবাসীদের পাঠানো এই অর্থ যেন গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করে আয় বাড়ানো হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা বলা হচ্ছে। তবে আগামী দিনগুলোয় আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন থাকবে, তার ওপর নির্ভর করবে সেই রেমিটেন্স বিনিয়োগ ও ব্যবহারের গতি-প্রকৃতি। তা না হলে আম-ছালা দুটিই হারিয়ে সবাই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিপতিত হয়ে যেতে পারে।

করোনার করাল গ্রাসে চাকরি হারিয়ে প্রবাসীরা দেশে ফিরে এলে পুনরায় সেখানে ফিরে যাওয়ার মতো ইতিবাচক পরিস্থিতি অতি দ্রুত তৈরি হবে না বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, প্রবাসীরা তল্পিতল্পা নিয়ে একেবারেই দেশের বাড়ি চলে আসছে।

এদিকে বেশ ক’দিন ধরে সাধারণ মানুষ রাজধানীসহ বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। ভাড়া নিয়ে ঢাকার বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়ের মধ্যে নানা ঝগড়া-ফ্যাসাদের কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। কয়েক মাসের বকেয়া ভাড়া দিতে না পারায় অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। কলাবাগানের এক মেস এবং পূর্ব রাজাবাজারের এক হোস্টেলের ৩৮ ছাত্রের জামাকাপড়, ট্রাঙ্ক, ল্যাপটপ, বই-পুস্তক, সনদ ইত্যাদি ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে।

করোনা ছুটিতে ছাত্ররা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেলে এ ঘটনা ঘটানো হয়। এজন্য ভুক্তভোগী ছাত্ররা বাড়িওয়ালার নামে থানায় মামলা করেছে এবং মালিক গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

আমাদের আর্থসামাজিক জীবনে করোনার নেতিবাচক প্রভাব খুব নির্দয়ভাবে হানা দিয়েছে। অর্থনীতির প্রাণ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স শিগগিরই কমে যাবে। পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চুপসে যাচ্ছে।

সেগুলোতে নতুন নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের তোড়জোড় চলছে। গত মাসে পোশাক শিল্প থেকে কাজ হারিয়ে শুধু রংপুর বিভাগেই দু’লাখ শ্রমিক গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে পত্রিকার খবরে জানা গেছে। ওইসব পোশাক শ্রমিকের নিজ গ্রামে তেমন কোনো জমিজমা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। ওরা বেশির ভাগ নারী শ্রমিক এবং বাড়িতে ফিরে এখন পথে বসে গেছে তারা।

পোশাক শ্রমিক ছাড়াও যারা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট সংস্থায় আউট সোর্সিংয়ের ভিত্তিতে কাজ করতেন, করোনার প্রভাবে তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ব্যাপকভাবে। তারা কয়েক মাস ধরে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। কেউ কেউ ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকে কর্র্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও ছাঁটাই করা হয়েছে।

করোনার আতঙ্কে বাসাবাড়ি থেকে গৃহকর্মীদের বাদ দেয়া হয়েছে। সংক্রমণের শঙ্কায় নতুন গৃহকর্মীকে আর বাসায় ডাকা হচ্ছে না। তাদের এখন মরণ দশা। ভিক্ষুকদের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। আগে থালা হাতে দশ বাড়ি ঘুরলেই ভিক্ষুকের পেট ভরে যেত। এখন তো বাসার চৌহদ্দিতেই ওদের ঢুকতে দেয়া হয় না। লঙ্গরখানা না খুললে ওদের কী অবস্থা হবে?

আগামী দিনের আতঙ্ক খুব ভাবিয়ে তুলেছে কর্মহীন মানুষকে। তাই যাদের সামান্য ভিটেমাটি আছে, তারা শহরের কঠিন পরিবেশ ছেড়ে মরিয়া হয়ে নিজ নিজ গ্রামের দিকে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে দেশের বহু গ্রামে এখন বন্যা। ১৪ জেলায় মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল ডুবে গেছে। কাজকর্ম নেই। এর সঙ্গে শহরফেরত কর্মহীন মানুষ যুক্ত হয়ে দ্রব্যমূল্যের স্ফীতি ঘটেছে, অপরাধ বেড়ে গেছে।

এটাই আজকের দিনে সবচেয়ে ভয়ের ও ভাবনার বিষয়। আমাদের ১৭ কোটি মানুষের ১০ কোটি আজ আর্থিক ক্ষতির হুমকিতে পড়েছে। ভাড়া কমিয়ে দেয়ার পরও কেউ বাসা ভাড়া নিতে আসছে না বলে জানা গেছে। শহরগুলোয় যারা বাড়িভাড়ার অর্থ দিয়ে সংসার চালাত, তারাও কি তবে গ্রামে চলে যাবে? শহরগুলো কি তবে ফাঁকা হয়ে যাবে? এগুলো শুধু আশঙ্কার কথা নয়; বরং চরম বাস্তবতার ইঙ্গিত।

এ ধরনের বিপর্যয় অতীতে অনেক হয়েছে। তাই আমাদের সতর্কতার সঙ্গে এই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এগুলো অবহেলা বা অবজ্ঞা করার মতো বিষয় নয় মোটেই।

করোনা আতঙ্কে মানুষের মন ভেঙে যাওয়ার মধ্যেও অনেক দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রগুলো করোনা সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটে সারা পৃথিবীর অগণিত মানুষ এখন দিশেহারা।

সামনের দিনগুলো আরও ভয়ংকর হবে বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। অনাগত সেই যুগে করোনার চেয়ে অতি ভয়ংকর কোনো মনো-সামাজিক ব্যাধি বা পরি-সামাজিক দুর্যোগ এলে হয়তো পৃথিবীতে প্রতিবাদ করার মতো কোনো মানুষকে সেদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এখনও সময় আছে, আসুন হাল ছেড়ে না দিয়ে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিজের মতো করে ভাবি ও মেনে চলি। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও সমষ্টি পরিবেশের যথাযথ উপকার করতে না পারলেও সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসি।

যারা বাঁচার তাগিদে জীবিকার সন্ধানে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, তাদের জন্য সরকারিভাবে সম্ভব না হলে এনজিওদের সম্পৃক্ত করে জরুরি ভিত্তিতে কাজের ব্যবস্থা করা উচিত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কুটিরশিল্প উদ্যোক্তাদের জরুরি ঋণসহায়তা প্রদান করতে হবে।

কৃষিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার লড়াই নতুনভাবে শুরু করতে হবে। এ ভয়ংকর সময়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে সতর্ক পরিকল্পনা নিয়ে সামনে পা ফেলতে হবে সবাইকে।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

fakrul@ru.ac.bd

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: