সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাবাহীন পৃথিবীতে এক বছর এবং টুকরো স্মৃতির সিম্ফনি




  • আব্দুল ওয়াদুদ ময়নুল

সন্তানের সুখ পৃথিবীর সব বাবারাই চায়। এই সুখকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাবা কত যে কষ্ট করে থাকেন তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।  আমার জীবনে এই পর্যন্ত আসার পেছনে অবদান একমাত্র আমার বাবার শাষন। তাঁর চোখ রাঙানি দেখলে বুঝা যেত যে আমার পায়ের নিচের মাটি তরতর করে কাঁপছে এবং চোখে ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গ উড়তে দেখা যেত। তাঁর কড়া মন মেজাজ সসম্পর্কে

আমাদের বাড়ি সহ আশপাশের সবারই সাম্যক ধারণা আছে। তিনি সবসময় এক কথাথেই অটল থাকতেন। যেটা বলতেন সেটা করতেনই। সবকিছুর পরেই তাঁর এই শাষনে আজ এদ্দুর আসতে পেরেছি।

বাবার জীবদ্দশায় আমার যেকোনো বিষয়ে আর কারো সাথে পরামর্শের প্রয়োজন মনে করিনি। ছোটকালেই বাবা যে দুইটি কথা সবসময়ই বলতেন- পড়লে ভাল করে পড়ো, আর না হয় কৃষি কাজে নামো। খারাপ ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করা তো দূরের কথা তাদের সাথে এক পা’ও হাঠবেনা। এ নিয়ে কত শাষনের শিকার হয়েছি  যার ইয়ত্তা নেই। যা এখনো মেনে চলি খুব এবং মেনে যাবো আমৃত্যু পর্যন্ত। এজন্য গর্ব করে বলতে পারি যে, ক্লাস সিক্সের পর থেকে কোনদিন ক্লাসে দ্বিতীয় হই নাই। হয়তো কপালের গুনে বা দোষে আজ প্রবাসী হতে হয়েছে। চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেই বাবাকে নিয়ে শতশত স্মৃতি ভেসে আসে। চোখের পানি ফেলা আর প্রার্থনা ছাড়া কিছুই করার নেই, কারণ স্রষ্টা কয়েকটা দিন শ্বাষ প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন আবার তার আদেশে উঠিয়ে নেন। বাবার কিছু স্মৃতিচারণ প্রকাশ না করে পারছিনা..

আনুমানিক ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ি। বাবার সাথে প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় সড়কের বাজারে যেতাম। পারিবারিক খরচ করে দেওয়ার পর তা নিয়ে বাড়িতে চলে আসতাম। পরিস্কার মনে আছে একদিন তিনি এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টমেটো ক্রয় করে টাকা পরিশোধ করছেন। ফেরত টাকা প্রায়ই আমি এনে তাঁর কাছে দেই। এইদিন ফেরত টাকা আমি আনতে গিয়ে ভূলবসত বাম হাত দিয়ে এনে ফেলি। বাবা দেখার পরপরই জনসম্মুখে কানের পাশেই এমন জোরে একটা থাপ্পড় দিয়েছেন, মাথা ঘুরিয়ে সাথেসাথে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ব্যবসায়ী এবং আশপাশের মানুষ অনেক্ষন মাথায় পানি দেওয়ার পর হুশ আসে। এও শেষ নয়, বাড়িতে যাওয়ার পরও এর খেসারত দিতে হয়েছে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কিছু আনতে গেলে অটোমেটিকলি আমার ডান হাত আগে চলে যায়। ভূলে বামহাত চলে গেলে হাত কাঁপতে থাকে।

সময়টা বলতে না পারলেও আনুমানিক  ক্লাশ সিক্স বা সেভেনে পড়ি। তাঁর নিষেধ থাকা সত্বেও বিকেলে কোথাও যেন খেলতে যাই। রাতে ফিরতে দেরি হওয়ায় বারান্দায় লাঠিসোটা নিয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। মাকে বলে দিয়েছেন যে, যদি আসি আমাকে যেন আশ্রয় এবং খানাদানার ব্যবস্থা না করা হয়। আমি বাড়িতে আসার আগেই খবরটি পেয়ে যাই। বাড়িতে না এসে পাশের বাড়িতে কিছুক্ষণ থেকে চাচার ঘরেই রাতযাপন করি। সকাল পর্যন্ত বাড়ির কেউই বাবাকে শান্ত করতে পারছেন না। আমাকে কড়া শাসন করবেই। মাথায় বুদ্ধি এলো যে, মাকে বলি আমি ভারতে পালিয়ে যাব। আর ফিরে আসবোনা। এই কথাটি তাঁর কানে গেলে আম্মাকে ২০০০ টাকা দিয়ে বলেন যে, সে যেহেতু ভারতে যেতে চাচ্ছে এই টাকাগুলো দিয়ে দাও। যাওয়ার আগে যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। সে যেন নিরাপদে ভারতে পৌছায়। এই কথা শোনার পর কোন উপায়ান্তর না পেয়ে কিছু উত্তম মাধ্যম খেয়ে মুচলেকা দিয়ে ঘরে আশ্রয় পাই। শুধু খেলা ধুলাকে কেন্দ্র করে এরকম শতশত ঘটনা আছে।

ক্লাস সেভেনে পড়ি। ছোট থেকে বাবার কাছে একটি বাইসাইকেলের আবদার ছিল। দিচ্ছেন দিচ্ছেন বলে দেওয়া হয়না। তারপর বাহানা ধরলেন যে, এইবার ক্লাসে ফাস্ট হলে ক্রয় করে দেবেন। শুধু এই সাইকেলের কারণে ফাস্ট হয়েছিলামও। ঠিক পরের দিন সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। সাইকেলের সখ শেষে দুই বছর পর মোটর সাইকেলের বাহানা ধরলাম। ঠিক একই ভাবে দিচ্ছেন দিবেন বলে দেওয়া হয়না। অনার্স প্রথম বর্ষে যখন ভর্তি হব তখন তিনি একদিন ডেকে কাছে এনে বললেন- বাবা, তোকে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আছে আমার ; কিন্তু আমি এজন্য দেইনা যে রোড এক্সিডেন্টের ভয়। আমার একমাত্র ছেলে তুই। তরে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন। আমার খুব ভয় লাগে। তোর কিছু হলে আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো। আমাদের পরিবারের সম্বল বলতে একমাত্র তুই’ই। তোর কিছু ঘটে গেলে আমরা বেঁচে থেকে কী লাভ! এই কথাগুলো আমার মনে তখন খুব আঘাত করছিল। বাবার ভালবাসা দেখে আমার চোখে অশ্রু ঝরছিল। একজন ছেলেকে নিয়ে পিতার স্বপ্ন, চিন্তা কতটুকু থাকতে পারে তখন বুঝতে পারি। এর পর থেকে মোটরসাইকেল চাওয়ার আগ্রহটা মন থেকে উঠে যায়।

এরকম কত স্মৃতির কথা নাই বললাম। তারপর সিলেটে এমসি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সে ভর্তি হলাম। ২০১০ সালে অনার্সে তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন অবস্থায় পরিচিত অনেকেই সহজে লন্ডনে চলে আসছে। ভীসা পদ্ধতি একেবারেই সহজ। সখ জাগলো আমারও। কিন্তু বাবাকে বিষয়টি অবগত করলে না করবেন নিশ্চিত ছিলাম। তাঁকে না জানিয়েই ছোট দুলাভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে পাসপোর্ট প্রস্তুত করলাম। একজনের সাথে চুক্তি করে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা পর্যন্ত দিয়ে দিছি তাঁর অনুমতি ছাড়া। পাসপোর্ট কালেকশন করার এক সপ্তাহ আগে চাচা ও দুলাভাইদের নিয়ে বিষয়টি জানানো হলে বাবা আগুন। কেন এমন করতে গেলাম? তাঁর একটাই কথা একমাত্র ছেলেকে বিদেশে দিতে রাজী নয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সম্মত হলেন। সপ্তাহ খানেক পরে ভীসাও পেয়ে গেলাম। বিদেশে আসার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হতেই বাবা একটি কথাই বলছিলেন-তুই চলে যাচ্ছিস, তর মা বাবা মারা গেলে কে দাফন করবে? কে মাটি দেবে আমাদের? বলছিলাম -শুধু দোয়া করবেন বাবা। বাবার এই আফসোসটি হয়তো আল্লাহ্ পাক কবুল করেছিলেন-

গত বছরে ঠিক এই সময়ে ফ্রান্সে রমজান পালন করছি। প্রতিদিন মায়ের সাথে ফোনে কথা হলেও বাবার সাথে সপ্তাহে একবার ফোন করা হতো। মা-বাবা সুস্থ ছিলেন। বাবার বার্ধক্যজনিত অসুখ ছাড়া তেমন বড় কোন অসুস্থ ছিলেন না। ফোন দিলেই বাবা শুধু বলতেন ” আমরা ভাল আছি; নিজের প্রতি যত্ন নিও”। ১৮ রমজান। হঠাৎ স্ত্রীর ম্যাসাজ, এই মুহূর্তে আম্মার কাছে ফোন দেও। ম্যাসাজ দেখেই বুজার বাকি রইল না যে, বিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। মাকে ফোন দিতেই কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন বাবার কথা। ইফতারের পর হঠাৎ আব্বা অজ্ঞান হয়েছেন। হুশ নেই বাবার। ইশারায় কথা বলছেন। রাত হয়ে গেছে অনেক সিলেটে নেওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে হুশ ফিরলেও পুরোপুরি কথা বলতে পারছেন না। সকাল হলেই নিয়ে যান সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছে মাথায় ইনফেকশন হয়েছে, গুরুত নয়। আমি দেশে আসতে চাইলে সবাই নিষেধ করছেন না যেতে। ১৯ রমজান সকালে যথারীতি কাজে গিয়ে বিকেল ৩ টায়  কাজ থেকে বাসার জন্য রওয়ানা দিচ্ছি। ট্রেন স্টেশনে এসে আব্বার খবর নিয়ে জানতে পারি অবস্থা গুরুতর। ICU তে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এই কথা শোনার পর ট্রেন স্টেনশন থেকে বাসায় না গিয়ে সোজা গারদু নর্দে একটি ট্রাভেলস এজেন্সিতে টিকেট করতে যাই। এবং পাঁচ ঘন্টা পরেই এমিরাটস এয়ারলাইন্সের টিকেট কনফার্ম করে বাসায় গিয়ে গোসল করেই সোজা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। এই সময়ে রহিম, মিজান ভাই, শরিফ ভাই, শাহ সুহেল, বাবলু, শুয়েব চাচা এবং রুমমেটদের শান্তনা ভূলার নয়। সারারাতে লং জার্নি করে ২০ রমজান ভোরে ঢাকায় পৌছি। সকাল ১০ টায় সিলেট ইবনে সিনায় পৌছে আব্বার এমন সংকটাপন্ন অবস্থা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। সবার পরামর্শে ICU থেকে বাড়িতে নেওয়ার পথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গাড়িতে করে বাবার লাশ সহ দুপুর ১ টায় আমি বাড়িতে পৌছার কিছুক্ষণ আগে আমার ছোট মামা মরহুম মাওলানা অলিউর রহমানের মৃত্যুর খবর আসলো। একই পরিবারে একই সাথে দুটি মৃত্যুর খবরের মুহুর্তটা পৃথিবীর যেন দ্বিতীয় কারোর না হয়। মা-বাবার একমাত্র পুত্রসন্তান হওয়ায় এই শোককালীন মুহুর্তে আমার মায়ের কাছে থাকতে পারাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা মনে করি। ২০ রমজানেই বাবা-মামার জানাযা একই সাথে সাতবাক ইদগাহ হাফিজিয়া মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পারিবারিক গোরস্থানে বাবাকে দাফন করা হয়।

আল্লাহ্ পাক আমার আব্বাকে জান্নাতবাসী করুক।

সবশেষে একটি কথাই বলবো। মা-বাবা হচ্ছেন আমাদের জীবনের অক্সিজেন। মাথার মুকুট। দুনিয়ায় থাকতে তাঁদের দায়িত্ব আদায় করুন। বাবা ছাড়া পৃথিবী যে কথ কষ্টের তা অপূরণীয়।

লেখকঃ অনলাইন এক্টিভিস্ট ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফরাসী নাগরিক।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: