শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

Sex Cams

মাওলানা মুহাম্মদ জমীরুদ্দীন : একজন বিনয়ী মানুষের প্রতিচ্ছবি




মাওলানা জমীরুদ্দীন (বামে) ও সেলিম আউয়াল (ডানে)

সেলিম আউয়াল

দূর থেকে তাকে খুব গম্ভীর মনে হলেও আসলে তিনি সেই রকম নন। খুব প্রাণখোলা মানুষ। খুব সহজে তার কাছে যাওয়া যায়। তিনিও পারেন সবাইকে ঝটপট আপন করে নিতে। তার মধ্যে বুজুর্গ বুজুর্গ ভাব নেই। তাকে না চিনলে, তার চাল চলনে মনে হবে আর দশজন মানুষের মতো একজন সাধারণ মানুষ।
চলনে বলনে সাধারণ হলেও এই অসাধারণ ব্যক্তিই ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ জমীরুদ্দীন। সিলেট নগরীর প্রানকেন্দ্র হাজী কুদরত উল্ল¬াহ জামে মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতীব। আর উপরের মন্তব্যটুকুন হচ্ছে তার সাথে এতেক্বাফে দিনরাত কাটানো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির। তিনি আরো বললেন, মাওলানা জমীরুদ্দীন একজন বিনয়ী মানুষ। এতেকাফের সময় রাতে তারাবির নামাজের পর বিভিন্ন মাসলা মাসায়েল নিয়ে কথা হতো। আমাদের সাথে কয়েকজন আলেম ছিলেন, যারা মাওলানা জমীরুদ্দীনের চেয়ে জুনিয়র। একেকদিন একেকজন আলেম আলোচনা করতেন। আমরা দেখতাম অন্য কোন আলেম যখন কথা বলতেন তখন মাওলানা জমীরুদ্দীন সাধারণ শ্রোতার মতো চুপচাপ সবার পেছনে বসে তাদের কথা শুনছেন। তাকে দেখে মনেই হতো না তিনি নগরীর প্রধান মসজিদের ইমাম ও খতীব।
সেই বিনয়ী, প্রাজ্ঞ আলেম, কারি মাওলানা জমিরুদ্দিন আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। ১৩ জুন ২০২০ রাত ১১টায় মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
বিরাশী বছর বয়সেও মাওলানা জমীরুদ্দীনকে মনে হতো একজন প্রাণবন্ত তরুণ ছুটে বেড়াচ্ছেন। কখনো তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যেতো না। একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো নামাজ পড়ছেন, কোরআন তেলাওয়াত করছেন, বই পড়ছেন, লেখালেখি করছেন অথবা তার কাছে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
মাওলানা মুহাম্মদ জমীরুদ্দীনের জন্ম দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ করিমপুর ইমাম বাড়িতে। জন্ম সাল ১৯৩৮। এদেশের আর দশজন মানুষের মতো তারও জন্মসাল লেখা হয়নি। মা বাবার অনুমান ইত্যাদি মিলিয়ে জন্ম সাল চিহ্নিত করা হয়েছে। তার পিতা মরহুম আবদুল গনি ও মাতা মরহুমা মাইমুন নেসা। তাদের পূর্বপুরুষ সিলেট সদর উপজেলার বরইকান্দি ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ইমামবাড়ীর অধিবাসী ছিলেন। ব্রিটিশ শাসন আমলে তাদের একটি অংশ করিমপুরে চলে আসেন।
মাওলানা জমীরুদ্দীনের পড়াশোনার শুরু বালাগঞ্জ উপজেলার কুবেরালি প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে ক্লাস ফ্লোর পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি মিলিয়ে চলে যায় বেশ কিছুদিন। ১৯৫৪ সালে রাখালগঞ্জ দারুল কুরআন আলিয়া মাদ্রাসায় ইবতেদায়ি ৩য় শ্রেণি থেকে ছরফ জামাত পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। কিছুদিন রেঙ্গা তওয়াক্কুলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করে ১৯৬১ সালে সেখানে ছরপ জামাতে উত্তীর্ণ হয়ে ইলমে ক্বিরাত ও তাজবিদের সনদ লাভ করেন। এরপর আবার রাখালগঞ্জ সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৬৫ সালে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসায় আলিম ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৬৭ সালে আলিম, ১৯৬৯ সালে ফাজিল ও ১৯৭১ সালে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ইলমে হাদিসের সনদ লাভ করেন গাছবাড়ি আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ শায়খুল হাদিস মাওলানা শফিকুল হক বুলবুল’র কাছ থেকে। তাফসিরের সনদ অর্জন করেন সৎপুর মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা গোলাম হুসাইন’র এর কাছ থেকে।
সৎপুর দারুল হাদিস আলিয়া মাদ্রাসায় জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে ১৯৭১ সালে তার কর্ম জীবনের শুরু। এরপর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সফাত আলী আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। সেই কর্মকাল ছিলো ৯ মাস। একই সাথে কেরামত নগর জামে মসজিদের ইমাম হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার হাটুভাঙ্গা দারুস সুন্নাহ মাদ্রাসা যখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন তিনি সেই মাদ্রাসায় যোগ দিয়ে মাদ্রাসাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি ১১ মাস সেখানে অবস্থান করে মাদ্রাসার জন্য ১ একর জায়গা সংগ্রহসহ মাদ্রাসা বোর্ড থেকে দাখিলের শিক্ষা স্বীকৃতির ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৮ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী হাজি কুদরত উল্ল¬াহ জামে মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগ দিয়ে আজীবন সেই মহান দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত হাজি কুদরত উল্ল¬াহ ফুরকানিয়া মাদ্রাসায় মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে ঘাসিটুলা জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মাদ্রাসাটিতে আজ দাখিল পর্যন্ত অধ্যয়ন করা হচ্ছে। তিনি নিজের গ্রামে আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া নামক ইসলামি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
মাওলানা জমীরুদ্দীনের ওস্তাদদের মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হলেন মরহুম ক্বারি আব্দুর রকীব, ক্বারি গোলাম সুবহানী, মরহুম মাওলানা মুফাজ্জ্বল আলী সিকন্দরপুরী, মাওলানা আব্দুল লতিফ কানাইঘাটী, মাওলানা আব্দুর রহমান, মাওলানা শায়খ বদরুল আলম রেঙ্গা, মাওলানা সিকন্দর আলী, শায়খুল হাদীস মাওলানা হবিবুর রহমান ইছামতি, মাওলানা ফজলুল করীম কুমিল্ল¬া, মাওলানা আব্দুল জব্বার গোটাগ্রামী, মাওলানা মুতাহিত আলী জকিগঞ্জী। বিশেষ করে ক্বারি মৌলভী বশীর উদ্দীন তাকে ছেলের মতো ¯েœহ করতেন এবং তাঁর বিশেষ তত্ত্বাবধানে তিনি ইলমে ক্বিরাত ও তাজবিদে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। যা তাঁর বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ইলমে আক্বাইদ, ইলমে হাদিস ও আছমাউর রিজাল শাস্ত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা আবু আবদিল্ল¬াহ মুহাম্মদ ইসমাইল রাইয়াপুরী র. এর কাছ থেকে নির্দেশনা লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে আছমাউর রিজাল শাস্ত্রের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে ড. আহমদ মাহির তাঁকে যোগ্যতার সনদ প্রদান করেন।
মাওলানা জমীরুদ্দীন ইসলামি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তাঁর লেখা বইগুলো হচ্ছে আমি ইত্তেহাদুল উম্মায় যোগ দিলাম কেন? আপনি যোগ দেবেন কেন?, আধ্যাত্মিক পরিবেশ, কিতাবুল হজ্ব বা হজ্বপর্ব। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে হুসনুল কুরআন ও দ্বীনদারী জীবন। তিনি সিলেটের বিভিন্ন মসজিদে নিয়মিত আল কুরআনের তাফসির পেশ করতেন। তিনি বেশ কয়েকবার পবিত্র হারামাইন শরীফাইন জিয়ারত করেন। মদিনা শরিফের ঐতিহ্যবাহী আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া পরিদর্শনকালে তাকে সেখান থেকে বিভিন্ন বিষয়ের কিতাব উপহার দেয়া হয়।
মাওলানা জমীরুদ্দীন বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনে উল্লে¬খযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। জালালাবাদ ইমাম সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, ইত্তেহাদুল উম্মাহ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মজলিসে ছদারতের প্রাক্তন সদস্য, সিলেট রইছুল ক্বোররা, আন্তর্জাতিক ইসলামি ত্রাণ সংস্থা জিদ্দা সউদি আরবের সাবেক মুবালিগ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র হাজী কুদরত উল্ল¬াহ মসজিদ সিলেট। এছাড়া আধ্যাত্মিক রাজধানী বাস্তবায়ন পরিষদ সিলেটের পৃষ্ঠপোষক, বৃহত্তর ঘাসিটুলা জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও সুপার, সিলেট যাকাত বোর্ডের সদস্য, আঞ্জুমানে খেদমতে কুরআন সিলেটের সাবেক সহসভাপতি। বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি সিলেট মহানগরের সহসভাপতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তিনি সম্পৃক্ত।
মাওলানা জমীরুদ্দীন সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা গোলাম হুসাইন’র প্রথমা কন্যাকে বিয়ে করেন। তাদের ২ মেয়ে ও ৭ ছেলে। তারা হলেন ফারিহা বিলকিছ, ত্বওয়াহা মোস্তফা, তালহা মোস্তফা, হুমায়রা ইজ্জা, বদরুদ্দুজা মোস্তফা, নূরুল হুদা, সদরুল উলা মোস্তফা, মিছবাহুদ্দুজা মোস্তফা ও শামসুল হুদা মোস্তফা।
মাওলানা মুহাম্মদ জমীরুদ্দীনের নামাজে জানাজা ১৪ জুন বেলা ২টায় কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে নগরীর মানিকপীরের টিলা গোরস্তানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

লেখকঃ বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও

সহসভাপতি- কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: