ত্রাণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র সর্বত্রই চোখে পড়ছে। অরাজক-বিশৃঙ্খল অবস্থা। ঢাকায় কেউ যাত্রাবাড়ীতে সকালে ত্রাণ নিয়ে একই ব্যক্তি দুপুরে শনির আখড়ায় ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিচ্ছেন। কেউ কোথাও ত্রাণই পাচ্ছেন না। কেউ গত কয়েকদিনে ত্রাণ সংগ্রহ করে ঘর ভরে ফেলেছেন; কেউবা ঘরে বসে থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে উপোস করছেন।
বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি (ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট চাকরি, বেকার, টিউশনি করে জীবনযাপনকারী) লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে না পারায় নিদারুণ কষ্টে পড়ে গেছেন। উবার চালক, পরিবহন শ্রমিকদেরও একই দশা। অথচ প্রতিদিন রাজধানীতে ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ গ্রামে এখনো ত্রাণ বিতরণ শুরু না হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জেলা, উপজেলা শহর এবং গ্রাম পর্যায়ের চিত্র রাজধানী ঢাকার মতোই। যারা ত্রাণ পাচ্ছেন তারা প্রতিদিন পাচ্ছেন; যারা পাচ্ছেন না তারা কোথাও পাচ্ছেন না।
জানতে চাইলে সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী দলমত নির্বিশেষে ত্রাণের তালিকার কথা বলে একটা বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তা দেখা উচিত। কাজ নেই ঘরেবন্দি অথচ লজ্জা-শরমের কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে ত্রাণ নিতে পারছেন না।
অথচ ‘৩৩৩’ নম্বরে ফোন করলেই ত্রাণ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার প্রচারণা চলছে। এতোগুলো মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারণার পরও মানুষ সচেতন হচ্ছেন না। ৩৩৩ এ ফোন করে অনেকেই ত্রাণ পাচ্ছেন; মধ্যবিত্তদের উচিত ঘরে কষ্ট না করে ত্রাণ নেয়ার এই সুযোগ গ্রহণ করা।
এদিকে ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের এই সঙ্কট মুহূর্তে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে ত্রাণ নিতে পারবেন দেশের সাধারণ মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা অনুযায়ী এখন ৩৩৩ নম্বরে আমাদের সঙ্গে কানেক্টেড করে আমাদের জানালেই আমরা তার খাদ্যের ব্যবস্থা করছি। যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে অস্বস্তিবোধ করেন তাদের উচিত এই নম্বরে ফোন করে সহায়তা গ্রহণ করা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ঘরবন্দি মানুষের জন্য রাজধানী ঢাকা ছাড়ও সারাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। কিন্তু সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং সমন্বয়ের অভাবে ত্রাণ নিয়ে নয়-ছয় হচ্ছে। কেউ সপ্তাহে তিন থেকে চার দফায় ত্রাণ পাচ্ছেন। কেউ ১৫ দিনেও একবার ত্রাণ পাচ্ছেন না।
বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত যারা সামাজিক মর্যাদার কারণে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে পারেন না, আবার ত্রাণ চাইতে পারেন না; তারা রয়েছেন দারুণ কষ্টে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা শহরে কোথাও মধ্যবিত্তরা ত্রাণ পাচ্ছেন না। অথচ নিম্নবিত্তদের অনেকেই দৌড়ঝাঁপ করে এক দিনেই দুইবার ত্রাণ সংগ্রহ করছেন। এমনকি ত্রাণ বিতরণ করতে গেলে দেয়া যায় সবখানেই একই মুখ।
রাজধানী ঢাকা মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, বাসাবো, কমলাপুর, আরামবাগ, যাত্রাবাড়ী, কমদতলী, ধোলাইপাড়, মহাখালীসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে গৃহকর্মীদের (কাজের বুয়া) ছুটি দিয়েছেন। মহানগরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা পেশার মানুষ ঘরে বসে কষ্টে দিনাতিপাত করলেও ত্রাণের লাইনে এই গৃহকর্মীদের দেখা যায় বেশি।
রাজধানীতে জনপ্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ নিজেদের মতো করে ত্রাণ দিচ্ছেন। সব লাইনে দেখা যায় মহিলাদের সংখ্যা বেশি। আর এই মহিলাদের বেশিরভাগই গৃহকর্মী। যাত্রাবাড়ীর সুমি নামের এক গৃহকর্মীর ভাষ্য, তিনি গত এক মাসে যে ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন, অনায়াসে তা দুই বছর খেতে পারবেন। শনির আখড়ার আবুলের মা নামে পরিচিত এক গৃহকর্মী জানান, বাসার কাজ বন্ধ হওয়ার পর তিনি যে ত্রাণ পেয়েছেন তার অর্ধেক বিক্রি করে ৫ হাজার টাকা পেয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, আমরা সবখানে ত্রাণ দিচ্ছি। এরপরও মাঝে মাঝে অভিযোগ আসছে অনেকে ত্রাণ পাচ্ছেন না। যারা ত্রাণ পাননি তারা যদি ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে আমাদের বলেন যে ত্রাণ পাননি- তাহলে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি আছে, যারা কাছাকাছি থাকবে তারা যাচাই করে তাকে ত্রাণ দেবেন।
এদিকে গতকাল যাত্রাবাড়ী এলাকায় ফোন ও এসএমএস-এর ভিত্তিতে দিনমজুর ও অসচ্ছল মধ্যবিত্ত ২০০ পরিবারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে দেখা গেছে। ফোন ও এসএমএস-এর তালিকা ধরে সূত্রাপুর, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, রমনা, শাহাবাগ, বংশাল, কোতোয়ালী, ওয়ারী থানা এলাকায় চারটি টিমের মাধ্যমে রিকশা ও ভ্যানে করে বাড়ি বাড়ি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন।