সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনার হটস্পট বাংলাদেশ




Bangladeshi street peoples gathered to collect foods sit in lines, adopting social distancing rules as they received relief materials provided by local community during the nationwide lockdown as a preventive measure against the COVID-19 coronavirus pandemic in Dhaka, Bangladesh on April 3, 2020. (Photo by Sipa USA)No Use UK. No Use Germany.

বিশ্বে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪২ লাখ ৫৬ হাজার ৭২৯ জন। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫৫ জন। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৬০ জন এবং মারা গেছেন ২৫০ জন। সংখ্যাগত দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা কম মনে হলেও বাংলাদেশ কার্যত এখন করোনার হটস্পট। পর্যাপ্ত সংখ্যক পরীক্ষা না হওয়ার পরও প্রথম ৬০ দিনে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের দেশ হলো বাংলাদেশে। সুস্থতার হারও সবচেয়ে কম। করোনা সংক্রমণে মাত্র দুই মাসে ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া, ভারতকে ছাড়িয়ে ‘এশিয়ার হটস্পটে’ পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। আয়োতন, জনতত্ত¡-ঘনবসতি ও আক্রান্তের হার হিসাবে সংক্রমণের এ সূচক ভয়ঙ্করভাবেই স্পষ্ট।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন,দেশে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের করোনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পরীক্ষা বাড়লে শনাক্ত সংখ্যাও বাড়বে। এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করা নমুনার প্রায় ১৫ দশমিক চার শতাংশ পজিটিভ এসেছে। প্রতিদিন সংক্রমণের হার বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা লকডাউন ঠিকমতো কন্ট্রোল করতে পারিনি। টোলারবাগের মতো লকডাউন করতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সেটা না পারায় করোনা পুরোদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক জরিপ প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডোমিটার করোনা সংক্রমণ নিয়ে গবেষণায় বলা হয়, এক সপ্তাহ আগেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের গতিতে

পাকিস্তান ছিল এশিয়ার হটস্পট। গত কয়েকদিনে পাকিস্তানকে টপকে এক লাফে শীর্ষে ওঠে ভারত। আর এখন সবাইকে পেছনে ফেলে শীর্ষে বাংলাদেশ। আমরাই (বাংলাদেশ) এখন দক্ষিণ এশিয়ার আতঙ্ক। করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে ফ্রান্স-স্পেন-ইতালি ছিল এমনই ইউরোপের আতঙ্ক। এমনই সংক্রমণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও।

জনসংখ্যা বেশি হলেও আয়তন এবং তুলনামূলক পরীক্ষা কম হওয়ার পরও পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রথম ৬০ দিনের হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার বেশি। আবার, সুস্থতার হারে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের সুস্থতার হারের ধারে কাছেও নেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশে গত দুই মাসের মাত্র ৩ হাজার ৪১৭ জন সুস্থ হয়েছেন। চিকিৎসকদের আক্ষেপ চীনে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানার পর তিন মাস সময় পেলেও কার্যকর প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। দেরিতে হলেও লকডাউন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো। আইইডিসিআর এর তথ্য মতে, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ঠিক দুইমাস (৬০ দিন) মাথায় গত ৬ মে শনাক্ত হন ৭৯০ জন আর মারা যান তিনজন। পরবর্তী ৬ দিন আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যের সংখ্যা বেড়েছে।

৬০ দিনে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা একইসময় বিবেচনা করলে ব্রিটেন ও রাশিয়ার চেয়ে বেশি এবং প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ওয়াল্ডোমিটারের হিসেব মতে প্রথম ৬০ দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৮৯৮ জন, ব্রিটেনে আট হাজার ৭৭ এবং রাশিয়াতে এক হাজার ৮৩৬ জন।
গতকালের তথ্য অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯৬৯ জন, আর মারা গেছেন ১১ জন। দেশে মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৬০ জন। মারা গেছেন ২৫০ জন।

সংক্রমণের হার : করোনা রোগীর পরীক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে পেছনে। কচ্ছপ গতিতে করোনা পরীক্ষা চলছে বাংলাদেশে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত সোমবার পর্যন্ত ভারতে করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৮ জনের। তাদের মধ্যে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ৬৭ হাজার ২৫৯ জন। সংক্রমণের হার ৪ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। পাকিস্তানে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৮৯৪ জনের মধ্যে করোনা পজিটিভ ৩০ হাজার ৯৪১ জনের। সংক্রমণের হার ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

বাংলাদেশে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এক লাখ ৩৬ হাজার ৬৩৮ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৬৬০ জন। সংক্রমণের হার ১২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে এক লাখ ৭৫ হাজার ৬০৪ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৩ হাজার ৮২২ জনের। সংক্রমণের হার ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ায় এক লাখ ৬১ হাজার ৩৫১ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৪ হাজার ২৬৫ জন। সংক্রমণের হার ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ফিলিপাইনে এক লাখ ৭৩ হাজার ১৪৪ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৮৬ জন। সংক্রমণের হার ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।

এছাড়াও সউদী আরবে ৩৯ হাজার ৪৮, কাতারে ২২ হাজার ৫২০, আরব আমিরাতে ১৮ হাজার ১৯৮, ইসরায়েলে ১৬ হাজার ৪৯২ ও জাপানে ১৫ হাজার ৭৭৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই সব দেশে বাংলাদেশের তুলনায় করোনা পরীক্ষার হার তিনগুণের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে গত কয়েক সপ্তাহে কোনো মৃত্যু নেই। এই দেশগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যাও কম।

মৃত্যুর চিত্র : সারাবিশ্বে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩৫৫ জনের মৃত্যুর বিপরীতে বাংলাদেশে মারা গেছেন ২৫০ জন (বাংলাদেশে করোনাতে প্রথম মৃত্যু ১৮ মার্চ)। সংখ্যায় এটা কম মনে হলেও মৃত্যুর হার বেশি। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার প্রথম ৬০ দিনের পর্যবেক্ষণে মৃত্যুর ঘটনা ছিল রাশিয়াতে সবচেয়ে কম। সেখানে মারা যায় ৯ জন। একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মারা যান ২৩৯ জন। এরপর জার্মানিতে ২৬৭ জন।

আর বাংলাদেশে একই সময়ে (প্রথম ৬০ দিন) মারাযায় ১৮৬ জন। তার সঙ্গে চার দিন যোগ হয়ে মৃত্যের সংখ্যা ২৫০ হয়েছে। মৃত্যের এই সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম হলেও রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে করোনায় সর্বাধিক আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ৬০ দিনে মৃত্যের সংখ্যায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থান এখন বাংলাদেশের।

পরিসংখ্যানের এই তথ্য স্বস্তিদায়ক হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ করোনা চিকিৎসার হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে না মানা, আইসিইউগুলোতে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার অভাব এবং রোগীর বিভিন্ন জটিলতায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার বিষয়টি এ দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা ও যথাযথ নজরদারির অভাবকে স্পষ্ট করে তুলেছে।

পরীক্ষার চিত্র : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য বুলেটিনে জানানো হয় করোনা পরীক্ষার সুবিধা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায় দেশে ৩৭টি ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার সংখ্যা লাখের ঘরে পৌঁছলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনসংখ্যা এবং অন্যান্য করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পরীক্ষার সংখ্যা এখনও অপ্রতুল। আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা ডট ওআরজি-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে এখন পর্যন্ত এক হাজার মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭১ জন। ভারতে এই হার প্রতি হাজারে এক দশমিক ১৭ জন এবং পাকিস্তানে এক দশমিক ২৮ জন।

স্পেনে এই হার হাজারে ৩৪ জন, ইতালিতে ৪১ জন, ফ্রান্সে ১২ দশমিক সাতজন, তুরস্কে ১৫ দশমিক আটজন এবং ব্রিটেনে ১৮ দশমিক ৭১ জন, কানাডায় ২৮ দশমিক তিন জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ জনেরও বেশি মানুষের পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়াও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে আইসল্যান্ড প্রতি হাজারে ১৫৬ জনের পরীক্ষা করে তালিকার শীর্ষে রয়েছে।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: