সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে জাকাত ব্যবস্থাপনা




মোঃ শামছুল আলম

যাকাত শব্দের অর্থ শুচিতা ও পবিত্রতা, শুদ্ধি ও বৃদ্ধি। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ কুরআনে বর্ণিত আট প্রকারের কোন এক প্রকার লোক অথবা প্রত্যেককে দান করে মালিক বানিয়ে দেয়াকে জাকাত বলে।
নিসাব পরিমাণ সম্পদ (৫২.৫ তোলা রূপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা সমমূল্যের সম্পদ) থাকলে সে সম্পদের যাকাত দেওয়া ফরয। তবে যদি সম্পদের মালিক এতই ঋণগ্রস্থ হন যে নিসাব পরিমাণ সম্পদও মিটাতে অক্ষম বা নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার চেয়ে কম হয়, তার উপর যাকাত ফরয হবে না।
মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন-

‘নিশ্চয়ই ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)।

নিম্নে খাতগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করা হল-
(১) ফকীরঃ নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী। যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের ৮টি খাতের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন-

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্যতা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।
অতএব ফকীর যাকাতের মাল পাওয়ার হকদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে ছাদাক্বাহ প্রদান কর তবে উহা ভাল; আর যদি তা গোপনে কর এবং দরিদ্রদেরকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভাল’ (বাক্বারাহ ২/২৭১)।

(২) মিসকীনঃ যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের মধ্যে দ্বিতীয় খাত হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা মিসকীনকে উল্লেখ করেছেন। আর মিসকীন হল ঐ ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়। হাদীছে এসেছে-

আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, এমন ব্যক্তি মিসকীন নয় যে এক মুঠো-দু’মুঠো খাবারের জন্য বা দুই একটি খেজুরের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তাকে তা দেওয়া হলে ফিরে আসে। বরং প্রকৃত মিসকীন হল সেই ব্যক্তি যার প্রয়োজন পূরণ করার মত যথেষ্ট সঙ্গতী নেই। অথচ তাকে চেনাও যায় না যাতে লোকে তাকে ছাদাক্বাহ্ করতে পারে এবং সে নিজেও মানুষের নিকট কিছু চায় না।

(৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারীঃ আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের তৃতীয় খাত হিসাবে ঐ ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি যাকাত আদায়, হেফাযত ও বণ্টনের কাজে নিয়োজিত। অতএব উক্ত ব্যক্তি সম্পদশালী হলেও সে চাইলে যাকাতের অংশ গ্রহণ করতে পারবে। হাদীছে এসেছে,
ইবনু সায়ে‘দী আল-মালেকী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম এবং তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিলাম তখন তিনি নির্দেশ দিলেন আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি ইহা করেছি। সুতরাং আমি আল্লাহর নিকট থেকেই এর প্রতিদান নেব। তিনি বললেন, আমি যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। কেননা আমিও রাসূলুল্লাহ সা. এর সময় যাকাত আদায়কারীর কাজ করেছি। তখন তিনিও আমাকে পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন আমিও তোমার মত এরূপ কথা বলেছিলাম। রাসূল সা. আমাকে বলেছিলেন, যখন তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কিছু দেওয়া হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ কর। তুমি তা নিজে খাও অথবা ছাদাক্বাহ্ কর।

(৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতেঃ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কোন অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়। হাদীছে এসেছে-

আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) নবী সা. এর নিকট কিছু স্বর্ণের টুকরো পাঠালেন। তিনি তা চার ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দিলেন। (১) আল-আকরা ইবনু হানযালী যিনি মাজায়েশী গোত্রের লোক ছিলেন। (২) উআইনা ইবনু বাদার ফাযারী। (৩) যায়েদ ত্বায়ী, যিনি পরে বনী নাবহান গোত্রের ছিলেন। (৪) আলকামাহ ইবনু উলাছাহ আমেরী, যিনি বনী কিলাব গোত্রের ছিলেন। এতে কুরাইশ ও আনসারগণ অসন্তুষ্ট হলেন এবং বলতে লাগলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদবাসী নেতৃবৃন্দকে দিচ্ছেন আর আমাদেরকে দিচ্ছেন না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তো তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য এমন মনরঞ্জন করছি। তখন এক ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসল, যার চোখ দু’টি কোটরাগত, গন্ডদ্বয় ঝুলে পড়া, কপাল উঁচু, ঘন দাড়ি এবং মাথা মোড়ানো ছিল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। তখন তিনি বললেন, আমিই যদি নাফরমানী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীবাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন, আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করছ না। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইল। (আবু সা‘ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি তাকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ বলে ধারণা করছি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নিষেধ করলেন। অতঃপর যখন অভিযোগকারী লোকটি ফিরে গেল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ ব্যক্তির বংশ হতে বা এ ব্যক্তির পরে এমন কিছু সংখ্যক লোক হবে তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন হতে তারা এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমনি ধনুক হতে তীর বেরিয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে আর মুর্তি পূজারীদেরকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে। আমি যদি  তাদেরকে পেতাম তাহলে তাদেরকে আদ জাতির মত অবশ্যই হত্যা করতাম।

(৫) দাস মুক্তির জন্যঃ যারা লিখিত কোন চুক্তির বিনিময়ে দাসে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে মালিকের নিকট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়। অনুরূপভাবে বর্তমানে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমদের হাতে বন্দি হলে সে ব্যক্তিও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে।

(৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিঃ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে। হাদীছে এসেছে,
কাবীছা ইবনু মাখারেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি কিছু ঋণের যিম্মাদার হয়েছিলাম। অতএব এ ব্যাপারে কিছু চাওয়ার জন্য আমি রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, (মদ্বীনায়) আবস্থান কর যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট যাকাতের মাল না আসে। তখন আমি তা হতে তোমাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দান করব।

(৭) আল্লাহর রাস্তায়ঃ আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে যে কোন ধরনের প্রচেষ্টা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বা আল্লাহর রাস্তার অন্তর্ভুক্ত। জিহাদ, দ্বীনী ইলম অর্জনের যাবতীয় পথ এবং দ্বীন প্রচারের যাবতীয় মাধ্যম এ খাতের অন্তর্ভুক্ত।

(৮) মুসাফিরঃ সফরে গিয়ে যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে যাকাতের অর্থ দান করা যাবে। এক্ষেত্রে উক্ত মুসাফির সম্পদশালী হলেও তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতি সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার ইবাদত করার জন্য। পবিত্র কুরআন মজীদে তিনি মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এভাবে- “আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি” (সূরা আয্যারিয়াত-৫৬)

এই ইবাদত তিন প্রকারঃ
(ক) শারীরিক ইবাদত তথা নামায ও রোযা।
(খ) আর্থিক ইবাদত তথা যাকাত।
(গ) শারীরিক ও আর্থিকের সামষ্টিগত ইবাদত তথা হজ্জ।

এগুলো প্রত্যেকটা ইসলামের একেকটি রুকন বা স্তম্ভ। কোন মুসলমান যদি এর কোন একটিকে অস্বিকার করে সে আর ইসলামের গন্ডির ভিতরে থাকবে না। সরাসরি কাফের হয়ে যাবে। আর যদি কেউ অমান্য করে তার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা কঠোর শাস্তির কথা ঘোষনা করেছেন।

★যাকাতের গুরুত্ব এবং আদায় না করার পরিণামঃ

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারিমে যাকাতের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন যেমন ‘আর তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩)

সূরা মায়ারিজের ২৪-২৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন; ‘আর যাদের ধন সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার।’
ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামায এবং রোজার সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে সম্পৃক্ত, পক্ষান্তরে যাকাত ও হজ্বের সম্পর্ক অর্থের সাথেও রয়েছে। বিশেষভাবে যাকাত ধনী বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপরই ফরয হয়ে থাকে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে গ্রহণ করা হবে, আর তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা অভাবী তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।’ (বুখারী ১৪০১)

ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে জাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে।
হাদীসের ভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়েছে যাকাতের বিশেষ গুরুত্ব সংবলিত অনেক হাদীস।

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল আর নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে।”(বুখারী, মুসলিম)

জারির ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপর।
(বুখারী, মুসলিম)
আবু সায়ীদ রা. বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিন বার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমযানের রোযা রাখবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’।’ (নাসায়ী: ২৩৯৫)

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তারপরও তারা কার্পণ্য করে, তারা যেন এই কৃপণতাকে নিজেদের জন্য ভালো মনে না করে। না, এটা তাদের জন্য অত্যন্ত খারাপ। কৃপণতা করে তারা যাকিছু জমাচ্ছে তাই কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড়ি হবে। পৃথিবী ও আকাশের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। আর তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ তা সবই জানেন। (সূরা আলে ইমরান: ১৮০)

অন্যত্র ইরশাদ করেন- যারা সোনা রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুখবর দাও। একদিন আসবে যখন এ সোনা ও রূপাকে জাহান্নামের আগুণে উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর তারই সাহায্যে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে- এ সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। নাও, এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর। (সূরা আত তাওবা: ৩৪-৩৫)

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘যে কোন স্বর্ণ বা রুপার মালিক যদি আপন সম্পদের মালের যাকাত আদায় না করে, তার এ সম্পদকে আল্লাহ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে কিয়ামতের দিন তা দ্বারা পিঠ, পার্শ্ব এবং কপালে ছ্যাকা দিবেন। আর যখনই তা ঠাণ্ডা হবে সাথে সাথে আগুনে পুণরায় উত্তপ্ত করা হবে। এমন দিনে তাকে শাস্তি দেয়া হবে যে দিনটি হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। আর বান্দার বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। অত:পর সে দেখতে পাবে তার গন্তব্য হয় জান্নাতের দিকে নয়তো জাহান্নামের দিকে।’ (মুসলিম)

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’ (বুখারী)

যাকাত গরিবের প্রতি কোন করুণা নয় বরং তার হক- যা ধনী ব্যক্তিকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ কারণে আবু বকর রা. বলেছেন, ‘যারা রাসুল সা. এর যুগে একটি উটের রশিও জাকাত হিসেবে আদায় করত আর এখন তারা যদি জাকাত দিতে অস্বীকার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ (বুখারী: ১৩১২)

তার এ ভাষণের মর্মার্থই ছিল, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যাতে কেউ কাউকে তার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে।
আজ সমাজের মানুষ নামায-রোযার প্রতি যতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে সে তুলনায় যাকাতের গুরুত্ব একেবারে নগণ্য। অথচ আমাদের পুরো জীবনটাই একটি বিক্রিত পণ্য। আল্লাহ বলেন-

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআ’লা জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন”।

আল্লাহ খরিদ করে মূল্য হিসেবে প্রদান করেছেন জান্নাত। তাই জান-মাল যেহেতু আল্লাহর ক্রয়কৃত সম্পদ সুতরাং তিনি যদি নির্দেশ দেন যে, রাত-দিন সিজদায় পড়ে থাক, অন্য কোন কিছুই করতে পারবেনা এবং সব উপার্জিত সম্পদ শতকরা শতই আল্লাহর জন্য গরীবকে দিয়ে দাও, তাহলে এ নির্দেশ পালন করতে বাধ্য ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা তা বলেন নি, বরং নির্দিষ্ট কিছু সম্পদের শতকরা মাত্র আড়াই টাকা প্রদান করতে বলেছেন।

নবী সা. নিম্নের আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাদেরকে আল্লাহ তার অনুগ্রহে ধন দৌলত দিয়েছেন এবং কৃপণতা করে তারা যেন এ ধারণা না করে যে, এ কৃপণতা তাদের জন্যে মঙ্গলজনক, বরঞ্চ এ তাদের জন্য অত্যন্ত অমঙ্গলজনক। কৃপণতা করে যা কিছু তারা জমা করে রেখেছে কেয়ামতের দিন তা হাসুলি বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হবে। [সুরা আলে ইমরান ১৮০]

একদিন নবী সা.  দেখলেন যে, দুজন মহিলা হাতে সোনার কঙ্কণ পরিধান করে আছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এর যাকাত দাও কিনা। তারা না বললে নবী বললেন, তোমরা কি তাহলে এটা চাও যে, এ সবের পরিবর্তে তোমাদের আগুনের কঙ্কণ পরানো হবে? তারা বললো না না, কখনোই না। তখন নবী (সা.)  বললেন, এ সবের যাকাত দিতে থাকো। [তিরমিযি]

হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) বলেন, নবী সা. খুতবা দিতে গিয়ে বলেন, হে লোকেরা! লোভ লালসা থেকে দূরে থাকো। তোমাদের পূর্বে যারা ধ্বংস হয়েছে তারা এ লোভ লালসার জন্যেই হয়েছে। লোভ তাদের মধ্যে কৃপণতা ও মনের সংকীর্ণতা সৃষ্টি করেছিল। ফলে তারা কৃপণ ও ধনের পূজারী হয়ে পড়ে। এ তাদেরকে আপনজনের প্রতি দয়া মায়ার সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রেরণা দেয় এবং তারা দয়া মায়া ছিন্ন করার অপরাধ করে বসে। এ তাদেরকে পাপাচার প্রেরণা দেয় এবং তারা পাপাচার করে। [আবু দাউদ]

যাকাত দানের ফলে যাকাত দাতার সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সম্পদের ওপর থেকে বালা মুসিবত দূর হয়। কোরআনুল কারিমের ৩২টি জায়গায় জাকাতের কথা উলে্লখ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, প্রকৃতপক্ষে সেই যাকাত তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে’। (সূরা রুম, আয়াত-৩৯)।
যাকাত দানের মাধ্যমে সম্পত্তি হ্রাস পায় না। বরং আল্লাহ যাকাত দাতার প্রতি খুশি থাকেন। যাকাত দানের ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে যাকাত দাতার সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। এছাড়া যাকাতের মাধ্যমে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।
যাকাত দানের মাধ্যমে এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের হক আদায় হয়ে যায়। জাকাতের মাধ্যমে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হয়।
গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটে। সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বৃদ্ধি পায়, দারিদ্র দূর হয়।

যাকাত আদায় করার দায়িত্ব সরকার বা রাষ্ট্রের। কিেন্তু সমকালীন বিশ্বে ইসলামী অনুশাসন না থাকায় কোথাও যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু নেই। যার কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই ব্যক্তি পর্যায়েও যাকাত আদায়ের ব্যাপারে উদাসীনতা দেয়া যায়। কিয়ামতের কঠিন বিপদের দিনে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে হলে যাকাত আদায় করতে হবে অবশ্যই। এ ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত আল্লাহ তা‘আলার কাছে গৃহীত হবে না। প্রতাপশালী বিচারকের সামনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে। যেভাবে হোক না কেন যাকাত দিতেই হবে- রাষ্ট্র বা সরকার জাকাত আদায় করতে আসুক বা না আসুক। মসজিদ আছে ইমাম নেই বলে যেমন নামাজ থেকে মাফ পাওয়া যায় না যাকাত উসুলকারী রাষ্ট্র বা লোক নেই বলে যাকাত আদায়ের কঠিন ফরজ থেকেও পলায়নের সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাকাত দিতে হবে। অন্যথায় যাকাত অনাদায়ের যে শাস্তি নির্ধারিত আছে তার অবধারিত কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে বুঝবার এবং তদনুযায়ী আমল করবার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: