এম হুমায়ূন কবীর
লিবিয়াতে মানবপাচারকারীদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ২৬ জন বাংলাদেশি এবং আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও ১১ জন। আগেই মৃত্যু হওয়া এক মানবপাচারকারীর পরিবারের সদস্যদের হাতে মোট ৩০ জন হত্যার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে বাংলাদেশি ২৬ জনের বাইরে বাকি চার জন আফ্রিকার অধিবাসী।
আমি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং আহতদের সুস্থতা ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা করি। মূলত মানব পাচারকারীদের হাতে হতাহতের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে, বলা যায় এটি প্রাত্যহিক ঘটনা।
কিন্তু লিবিয়ার ঘটনায় একই সঙ্গে অনেক বাংলাদেশি হত্যার শিকার হওয়ায় বিষয়টি মিডিয়ার আকর্ষণ পেয়েছে বেশি।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতি বলুন বা উন্নয়নের অনুঘটক বলুন, সমাজের জন্য অভিবাসীদের অনেক অবদান রয়েছে। গত বছর অভিবাসীরা ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন দেশে।
এ বছরও তাদের রেমিটেন্স পাঠানো অব্যহত আছে, যদিও পরিমাণ খানিকটা কমে আসবে কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায়। আমাদের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও বিস্তৃত। সব বাজারই বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত।
এ কারণে আমরা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হব; কিন্তু কী পরিমাণ সেটা দেখার বিষয়। এরই মধ্যে অনেকে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন, অনেকে আসছেন। যারা থেকে গেছেন, তারাও আছেন চাকরিহারা হয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধানে।
লিবিয়ায় যে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেছে সেটি খতিয়ে দেখলে অনেকগুলো বিষয় সামনে আসবে। প্রথমত, এই যে লোকগুলো দেশ থেকে গেলেন বৈধ বা অবৈধ উপায়ে- তাতে তাদের ইচ্ছার সাথে একটি গোষ্ঠী তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে উন্নত জীবনের, দিয়েছে নানা প্রলোভন।
আমি ধারণা করছি এই লোকগুলো নিয়মিত পথেই আমাদের বিমানবন্দর পার হয়ে উন্নতির স্বপ্ন নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছে। দেখার বিষয় হল, এত রিস্ক নিয়ে কেন তরুণরা অনিশ্চিত ঝুঁকির পথে পা বাড়াচ্ছে, কেন এখানে তথা দেশে আমরা তাদের জন্য আশা তৈরি করতে পারছি না- এসব বিষয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার।
কারণ কোভিড-পরবর্তী সময়ের বিশ্বব্যবস্থা, দেশে দেশে আর্থিক মন্দা ও ব্যয় সংকোচনের বিষয় মাথায় রেখে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে আমরা আমাদের বেকার হয়ে পড়া, বিদেশ থেকে ফেরত আসা ও আসার আশঙ্কা তৈরি হওয়া শ্রমিকদের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করব, তা ঠিক করতে হবে এখনই।
দ্বিতীয়ত, দালাল গোষ্ঠী প্রলোভন দেখিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে মানুষকে পাচার করে বিপদের মুখে ফেলছে। মানব পাচার কিন্তু জঘন্য একটি বিষয়। এটি রোধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। যারা মানব পাচারে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের তরুণরা দালালদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। একদিকে তারা বিদেশের মরুভূমিতে, জঙ্গলে নির্মমভাবে জীবন দিচ্ছে বা পঙ্গু হচ্ছে, অন্যদিকে দালালরা দেশে তাদের পরিবারের লোকদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করছে।
আমরা দালালদের শাস্তির বিধান করতে পারিনি বলে সমস্যা রয়ে গেছে এবং মাঝে মাঝে সেটি জটিল আকার ধারণ করে, যার সর্বশেষ নজির দেখা গেল লিবিায় ২৬ বাংলাদেশির নির্মম প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। ভবিষ্যতেও যে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উন্নত অন্যান্য দেশ মানব পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র মানব পাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা এরই মধ্যে আমাদের মানব পাচারকারী অথবা মানব পাচারের রুট হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তির মুখে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমরা যদি যথেষ্ট পরিমাণে সংবেদনশীল না হই মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে, যদি শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারি, এমনকি দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হই তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ থেকে ৯১ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত আনার চাপের মধ্যে রয়েছি আমরা। এছাড়া বিভিন্ন দেশে অবৈধ অভিবাসীর উপস্থিতি ও নানা নেতিবাচক ঘটনা আমাদের শ্রমবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের শ্রমবাজার ও অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণের সমস্যা-সম্ভাবনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। অভ্যন্তরীণভাবেও বিভিন্ন বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করতে হবে।
কোভিড-১৯-এর পর শ্রমবাজারের চেহারা বদলে যাবে। আমরাই তো অনেকে এখন দেশে ঘরে থেকে অফিস করছি। এর অর্থ হচ্ছে মানুষ আরও বেশি যন্ত্রনির্ভর হচ্ছে, এমনকি মানুষনির্ভরতা কমে যাচ্ছে। এর কারণে শ্রমিকনির্ভর আমাদের কাজ কমে যাবে। সুতরাং, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়গুলো সংকুচিত হয়ে আসবে। এটি মোকাবেলায় আমাদের সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। কীভাবে অদক্ষ থেকে আদা দক্ষ ও দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দফতর মিলে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এনজিও ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে নিয়ে ক্রাশ প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হবে শ্রমিকদের আধা ও পুরো দক্ষ করে তোলার পেছনে।
তাহলে যে লাভ হবে তা হল কম শ্রমিক পাঠিয়েও বেশি শ্রমিক পাঠিয়ে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আমরা পেতাম তা বা তার চেয়ে বেশি পাব। কাজের নতুন নতুন বাজারও তৈরি হবে। এটি করতে পারলে দেশেও সহনীয় পর্যায়ে বেকারদের কর্মসংস্থান তৈরি করা যাবে, সুযোগ আসবে দেশের বাইরে থেকেও।
কোভিড-১৯-পরবর্তী তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে কমিউনিকেশন, প্রযুক্তি এবং স্থানীয় ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সমাজের, সংস্কৃতির মনোভাব শিক্ষা দিতে হবে। এগুলো একা সরকারের দ্বারা সম্ভব হবে না। আমরা যারা এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ও আছি তাদের সহায়তা নেয়াসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ থাকতে হবে। তাহলে আমরা যেভাবে পরিবার-পরিকল্পনা ও টিকাদানে সফল হয়েছি, এখানেও সেভাবে সফল হওয়া যাবে।
লিবিয়ায় যারা প্রাণ দিয়ে গেল তাদের মতো পরিণতি যাতে আর কারও না ঘটে সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেগুলো নিতে হবে। আমরা অনেক প্রতিকূল পরিবেশ অতীতে কাটিয়েছি, এটিও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
(অনুলিখন)
এম হুমায়ূন কবীর : সাবেক রাষ্ট্রদূত