আবদুল ওয়াহেদ
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের এই দন্ডটি সে কবেই অকেজো হয়ে গেছে।শিক্ষা হওয়া উচিত স্বনির্ভরতার।কিন্তু স্বনির্ভরতা শব্দটি মেরুদণ্ডহীন হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নদীর জোয়ারে ভেসে আধমরা প্রাণ নিয়ে বহু আগেই ওপারে গিয়ে ঠেকেছে।আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তো গোড়ায় গলদ।একজন শিক্ষার্থী যখন স্বনির্ভরতা অবলম্বন করতে গিয়ে পরীক্ষা ফেল করে তা আমরা মেনে নিতে নারাজ।তাকে যেভাবেই হোক পাশ করতেই হবে।পাশ করার ক্ষমতা আছে কিনা সে বিচারে না গিয়ে যখন পাশ করতেই হবে প্রত্যয়টি তার স্কন্ধে চাপিয়ে দিই ঠিক তখনই পরনির্ভরশীলতার বীজ অঙ্কুরিত হয়।
আবার পড়াশোনা শেষ না হতেই আমাদের যুবকদেরকে আমরা পরাধীনতার শিকলে বন্দি করে রাখি।তার ইচ্ছে আকাঙ্খার মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করে সমাজের মগজপঁচা ইচ্ছের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিই।তাকে চাকর হতেই হবে।দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে বহুযুগ আগে।কিন্তু আমাদের মনের দাসত্ব আজো অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে মাথা তুলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।মাসজুড়ে অন্যের কাজ করে যদি শেষের পাঁচদিন ধার করে চলতে হয়,কোম্পানি বেতন না দিলে উপোস থাকতে হয়,কাজে যেত দেরি হলে মাইনে কাটা যায়,আবার সেটা যদি হয় সমাজের কাছে সম্মানের তাহলে আমার কাছে তারচে দামী ও পবিত্র সেই দাস সমাজ।বানিজ্য করলে,কৃষি কাজ করলে যদি শিক্ষিত যুবকদের গায়ে গন্ধ ছড়ায় তাহলে কৃষি ও বানিজ্যের উপর ভুরি ভুরি ডিগ্রি প্রদান করা বিলাশিতা নয় কি?বেকারত্ব সামাজিক বোঝা আবার বেকারত্ব দূরীকরণের ফার্ম গঠন করাও সামাজিক পাপ ও অসম্মানের।কেবল লাল চামড়ার ভাড়া করা সংস্কৃতি ও তাদের দাসত্বই কেবল সম্মানের এ কুধারণা থেকে বের হয়ে এসে আমাদের যুবকদের কৃষি ও বানিজ্যে হাত দেয়ার এখনই সময়।
কৃষির কথাই বলা যাক।
আবু জাফর ওবায়দুল্লা’র- “তার করতলে পলি মাটির সৌরভ ছিলো” চরণ থেকেই স্পষ্ট বলা যায় আমাদের পূর্ব পুরুষ কৃষক ছিলেন।আর এখন মগজে দাসত্ব ও দাদাদের হাতের দিকে চেয়ে থাকার অভ্যেস লালন করতে গিয়ে আমরা কৃষিকে বারো আনা মাটি চাপা দিয়ে বসেছি।এদেশের কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের যথার্থ মূল্য দিতে আমাদের যত গায়ে জ্বালা।দেয়ালে পিট ঠেকে গিয়ে কৃষকরা নগরমুখি হয়ে শিল্পকে বেঁছে নিলেন। আর দাদারা আমাদের ট্যাগ দিলেন-তোমরাই তো শিল্পে একধাপ এগিয়ে।আরো একধাপ এগুতে আমরা খুশিতে হামাগুড়ি দিয়ে লাগলাম।ঠিক তখনই তলানিতে গেলো নুন,তেল,চাল,পেঁয়াজ।দাদারাও সুবিধামত দরজা বন্ধ করে দিলেন।এবার তোদের ভাতে মারবো,পানিতে মারবো শ্লোগানের আভাস পাওয়া গেলো।তারপর আমাদের দশগুণ চড়া দামে কৃষিজ পণ্য আমদানি করে বিলাশিতার তেল নাকে লাগিয়ে ঘুমাতে গায়ে লাগেনা।অথচ সেই দশগুণ দাম যদি আমার দেশের কৃষকদের দিই আমাদের একটা টাকাও আর বিদেশের মাটিতে গিয়ে পড়তোনা।একটা সময় সকলেই আমাদের কাছে হাত পেতে বসে থাকতো।কৃষির ভিত মজবুত থাকলে করোনা মহামারিতে অন্তত না খেয়ে মরার চিন্তা আমার দেশের মানুষকে করতে হতোনা।
ঠিক একইভাবে চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতেও আমাদের ফকির বলা সই।উঁচুতলার মানুষেরা সর্দি হলেও সিঙ্গাপুর রওনার অভিষাপ ভোগ করতে হচ্ছে আঠারো কোটি মানুষকে।বাইরের দেশে ডাক্তারি পাশ করে গবেষণা করবে,ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করবে,ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে প্রযুক্তি আবিষ্কার করবে।আর আমাদের দেশে ওই সকল শিক্ষার্থীরা হয়তো বিদেশে পাড়ি জমাবে নাহয় বিসিএস পাশ করে আমলা হবে।এ দোষ অবশ্য তাদের একার না,রাষ্ট্রের। কেননা,এদেশে প্রতিভার সঠিক মূল্য দেয়া হয়না।এখানে কোন ছেলে কিছু আবিষ্কার করলে জনগণের কাছে তা খেল তামাশা আর সরকারের কাছে মিলেনা অনুমোদন।এ নিয়ে আর বেশি বলার দরকার বোধ করছিনা।মূল কথাটিই হলো আমাদের মনন ও মগজের পরনির্ভরশীলতা মাত্র।
দেশের উত্তরোত্তর এসকল সমস্যা নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের খুব কবে ভাবার কথা।কিন্তু আপন কর্তব্য ভুলে গিয়ে,শিক্ষা,সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার গবেষণা ব্যাতি রেখে তেলা সংস্কৃতিতেই যখন সকলে গভীর মগ্ন সেখানে জাতির অদূর ভবিষ্যতে কি আশা করা যায়।শিক্ষিত সমাজ আজ ব্যাধিগ্রস্থ।প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত যেখানে বিদ্যাবুদ্ধির চর্চাকে হত্যা করে পদোন্নতির আশায় গণ্ডমূর্খ সমাজপতি ও নেতাদের পা চাটে সে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকার।মৃত ব্যাক্তির মাঝারে সিজদা দেয়া আর মুর্খ নেতার পা চাটা দুটোই সমানুপাতিক।কোনটিতে জাতির বিশেষ ফায়দা নেই।কেননা,মানুষের ভাগ্য দেবতা স্বয়ং মানুষ নিজেই।
সুতরাং, চাটুকারিতা, তেলাবাজি ও পরনির্ভরশীলতাকে ভুলে গিয়ে ঠিক যখনই নজরুলের মতো ‘আমার কর্ণধার আমি’ বলে স্বনির্ভরতার জয়ধ্বনি তুলতে পারবো তখনই দেশের ভবিষ্যত পাল্টে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।