ল্যুভ মিউজিয়ামে মোনালিসার সাথে একদিন
আলী বেবুল
গত ২৬ অক্টোবর ঘুরে এলাম শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির তীর্থভূমি প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভ মিউজিয়াম। দেখে এলাম লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অসাধারণ সৃষ্টি মোনালিসা। মোনালিসার রহস্য নিয়ে আজও মানুষের মনে হাজারও প্রশ্ন। একটি বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম। ইতালীর শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৫ শতকে এই ছবিটি অঙ্কন করেন। অনেক শিল্প-গবেষক রহস্যময় হাসির এই নারীকে ফ্লোরেন্টাইনের বণিক ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকন্ডোর স্ত্রী লিসা গেরাদিনি বলে সনাক্ত করেছেন। শিল্পকর্মটি ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ল্যুভ মিউজিয়ামের তথ্যমতে প্রায় ৮০% পর্যটক শুধু মোনালিসার চিত্রটি দেখার জন্য আসে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন, যিনি বিজ্ঞান বা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি তার প্রতিভা দেখান নি । তাঁর শিল্পকর্মগুলি ছিল অসাধারণ রহস্য পরিপূর্ণ। তাঁর একটি অসাধারন সৃষ্টি “মোনালিসা” ছবিটি । এখনও মানুষের কাছে “মোনালিসা” রহস্যময়।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত ‘মোনালিসা’ ছবির সম্পর্কিত তথ্য : মোনালিসা নামটির সাথে সাথে মনে অনেক রকমের প্রশ্ন এসে যায়। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন হয়, আলাদা আলাদা অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে মোনালিসার হাসি পরিবর্তন হতে থাকে। কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে মোনালিসার এই ছবিটির মধ্যে বিশাল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। যেমন ধরুন পাঁচশো বছরেও মানুষ কেন দেখতে পাইনি মোনালিসার ছবির মধ্যে এলিয়েনের ছবি লুকিয়ে রয়েছে ? “মোনালিসা” আসলে ছেলের না মেয়ের ছবি ? এই ধরনের অনেক প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে চলেছে মানুষ ।
মোনালিসা একটি এমন বিখ্যাত চিত্রকর্ম যেটি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সৃষ্টি করেছিলেন। এই ছবিতে মোনালিসা নামের যে নারীর সৌন্দর্য লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার রং তুলির আঁচড়ে এঁকেছিলেন তার সৌন্দর্যের পাশাপাশি ভুবন ভুলানো রহস্যময় হাসির সন্ধানে আজও মানুষ গবেষণা করে চলেছেন।
মোনালিসা এমন একটি পেইন্টিং যা আজও রহস্যের মায়াজালে আমাদের জড়িয়ে রেখেছে। রহস্যের পাশাপাশি এই চিত্রকর্মটির ইতিহাস ও জনপ্রিয়তা পৃথিবী বিখ্যাত। ল্যুভ মিউজিয়াম,প্যারিসে স্থানীয়ভাবে প্রদর্শিত এ ছবির মূল্য ১৯৬২ সালে হিসাব করা হয়েছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার।মুদ্রাস্ফীতি যোগ করে ২০১৬ সালে এর মূল্য দাঁড়ায় ৭৯০ মিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে মোনালিসার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৮৬০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পেইন্টিং হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
দর্শকরা যখন পেইন্টিংটি কাছ থেকে দেখে তখন তারা একজন সাধারণ নারীর প্রতিকৃতি দেখে বিস্মিত হয়। তার হাসি এবং দৃষ্টি সম্পর্কে রহস্য লুকিয়ে আছে। পেইন্টিংটি সৃষ্টির প্রায় ৫০০ বছরেও বেশি হয়ে গেছে। এর ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি বিবর্ণ হয়ে গেলেও মোনালিসার খ্যাতি সময়ের সঙ্গে বেড়েই চলেছে।
যে কারণে পেইন্টিংটি এতো মর্যাদাবান।
লিওনার্দো ১৫০৩ বা ১৫০৪ সালে ফ্রান্সেসকো দেল গিওকন্ডো নামে এক ধনী ফ্লোরেনটাইন ব্যবসায়ীর অনুরোধে প্রতিকৃতিটি আঁকা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসায়ী তার স্ত্রী লিসা দেল গেরাদিনির একটি প্রতিকৃতি চেয়েছিলেন। পেইন্টিংটি তার নতুন বাড়ির জন্য এবং তার দ্বিতীয় পুত্র আন্দ্রেয়ার জন্ম উদযাপনের জন্য করতে বলা হয়। তবে বিশেষজ্ঞ ও স্কলারদের মধ্যে তাদের পরিচয় নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। নামকরণের ক্ষেত্রে সেই সময়ে ইতালিতে মোনা মানে ম্যাডোনা, এভাবে সব নারীকে সম্বোধন করা হত। এখন যেমন মিসেস সম্বোধন করা হয়। এই মোনা থেকেই নামকরণ মোনালিসা হয়েছে। লিওনার্দো ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পেইন্টিংটির কাজ চালিয়ে যান। তিনি মারা যাওয়ার সময় এটি অসমাপ্ত ছিল।
লিওনার্দো ছবি আঁকার যেসব কৌশল তৈরি করেছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল স্ফুমাটো কৌশল, যার অনুবাদ করলে দাড়ায়, ‘লাইন বা সীমানা ছাড়াই ধোঁয়ার পদ্ধতি’। তৎকালীন সময়ে শিল্পীদের জন্য রূপরেখা বা লাইন তৈরি করে আঁকা একটি সাধারণ চর্চা ছিল। সে জায়গায় লিওনার্দো লাইন বা রূপরেখা ব্যবহার করেননি। আলো এবং ছায়ার বিভ্রম তৈরি করতে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে তিনি কাছের সাবজেক্টগুলোকে স্পষ্ট, আর দূরের সাবজেক্টগুলোকে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্পষ্ট করে তোলেন। মোনালিসার বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় কারণ হচ্ছে হাসি। লিওনার্দো দৃষ্টিকোণ এবং ছায়ার কাজের মাধ্যমে এমন একটি অনন্য হাসি তৈরি করেন,যা একধরনের অপটিকাল ইলিউশন তৈরি করে। দর্শক যখনই মোনালিসার চোখের দিকে তাকায়, মুখ হাসির মতো দেখায়। কিন্তু যখন দর্শকের দৃষ্টি হাসির উপর স্থির হয়, এটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন এটি কখনই হাসি ছিল না। আবার হাসির বিভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে, কেউ কেউ মনে করে যে, এটি একটি সুখী হাসি। আবার অনেকে বিশ্বাস করে এটি একটি দুঃখের হাসি৷
১৯১১ সালে ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে মোনালিসার পেইন্টিংটি চুরি হয়ে গিয়েছিল।
ভিনসেনজো পেরুজিয়া ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে মোনালিসার পেইন্টিংটি চুরি করেন। এই চুরির পরই বিশ্বব্যাপী মোনালিসা–ঝড় ওঠে, আন্তর্জাতিক শিরোনামে পরিণত হয়।বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধান এবং মোনালিসার জন্য দীর্ঘশ্বাস ছবিটির খ্যাতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ১৯ শতকের লেখকরা মানুষের মধ্যে মোনালিসার প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছিলেন। ল্যুভ মিউজিয়ামে মোনালিসার শূন্যস্থানটি দেখার জন্য প্যারিসে দেশি ও বিদেশি মানুষের ঢল নামে।মানুষ ভাবতে শুরু করে ছবি না থাকলেও মোনালিসার আত্মা তখনো সেখানে বিরাজমান। মোনালিসার সঙ্গে বিচ্ছেদ ফ্রান্সকে শোকগ্রস্ত করে তোলে। প্রায় দুবছর প্যারিস রয়ে যায় শোকের শহর।
পেরুজিয়া মিডিয়ার কারণে পেইন্টিংটি বিক্রি করতে পারছিলেন না। দুই বছর ধরে পেরুজিয়া পেইন্টিংটিকে স্যুটকেসের একটি ফলস-বটমের মধ্যে রেখেছিলেন। তারপরে তিনি এটিকে ইতালিতে পাচার করেন এবং ফ্লোরেন্টাইনে একজন শিল্প ব্যবসায়ীর কাছে এটি বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন। পেরুজিয়া নিজেকে একজন ইতালীয় দেশপ্রেমিক হিসেবে মনে করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন একজন পুরানো মাস্টারের কাজ তার দেশে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে উদযাপনের পরিবর্তে তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশেষে দুই বছর পর ইতালি থেকে ১৯১৪ সালের ৪ জানুয়ারি উদ্ধার হওয়া ছবিটি আবার ল্যুভ মিউজিয়ামে ফিরে আসে। এর আগে ফ্লোরেন্সের সেই শিল্প ব্যবসায়ী স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেন যে, একজন ব্যক্তি এটি বিক্রি করার বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ল্যুভর মিউজিয়ামে পেইন্টিংটি ফিরিয়ে আনার আগে এটি ইতালির বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করা হয়। ফরাসিরা এটিকে একটি জাতীয় সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে।
১৫১৯ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের প্রিয় দুর্গ ফন্টেইনব্লুতেও এটি জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হত। ১৮০০ সালে মোনালিসাকে নেপোলিয়নের বেডরুমে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
মোনালিসা নিঃসন্দেহে একটি ভালো পেইন্টিং হলেও এর এত জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কোনো একক কারণ নেই। বরং এটি বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার সমন্বিত ফসল। যা মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পেইন্টিংয়ে পরিণত করেছে।
মোনালিসা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম কি না, এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু ছবির যে বীমামূল্যের হিসাব, তাতে পৃথিবীর কোনো জাদুঘরে আর কোনো শিল্পীর গ্যালারিতে থাকা কোনো ছবি একে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ দেখেছেন।এই ছবি নিয়ে সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়েছে।ছবিটি চুরি হয়েছে, উদ্ধার হয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো মানুষকে একটি পেইন্টিংয়ের উল্লেখ করতে বলা হলে মোনালিসাই হয়ে উঠবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রথম। ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সময়কালে ছবিটি আঁকা, ছবিটি আঁকার শুরুতে শিল্পী ছিলেন ইতালির ফ্লোরেন্সবাসী। তিনি যখন ফ্রান্সে যান, এ ছবির কাজ অব্যাহত রাখেন। শিল্পী প্রয়াত হওয়ার পর রাজা ফ্রাঁসোয়া ছবিটি কেনেন। চতুর্দশ লুই মোনালিসাকে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে স্থানান্তরিত করেন। ফরাসি বিপ্লবের সময় মোনালিসাকে ল্যুভ মিউজিয়ামে আনা হয়। এটি কিছু সময় নেপোলিয়নের শোয়ার ঘরেও ছিল।
মোনালিসা কিন্তু ক্যানভাসে আঁকা তেলরং ছবি নয়। দা ভিঞ্চি মোনালিসা এঁকেছেন ৭৭ সেন্টিমিটার ৫৩ সেন্টিমিটার মাপের এই ছবি পপলার কাঠের তক্তার ওপর। তখন চিত্রশিল্পে ক্যানভাসের যথেষ্ট ব্যবহার থাকলেও ছোট মাপের কাজের জন্য রেনেসাঁ গুরুদের অনেকেই কাঠের আশ্রয় নিয়েছেন। মোনা মানে মাই লেডি, আদরের কেউ; আবার ইতালিয় ভাষায় মোনা মানে স্ত্রী জননাঙ্গ কিংবা বোকা মেয়ে।
১৯৫৬ সালে এক দুষ্কৃতকারী মোনালিসার গায়ে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে, একই বছর ডিসেম্বরে কেউ একজন পাথর ছুড়ে ছবির মোনালিসার গায়ে। মোনালিসার কনুইয়ের দিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অ্যাসিড নিক্ষেপের কারণেও ছবিটির বিশেষ ক্ষতি হয়। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মোনালিসাকে বুলেটপ্রুফ কাচের আস্তরণে ঢেকে দেয়। ২০০৫ সালে মিউজিয়ামের বর্তমান অবস্থানে আনা হয়। মোনালিসার এই আবাসকে কেউ কেউ বলে থাকেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ক্ষুদ্র কারাগার।
ল্যুভর বিশ্বের বৃহত্তম মিউজিয়ামগুলির মধ্যে একটি এবং প্রতিবছর ৯ মিলিয়নেরও বেশি লোক পরিদর্শন করে। সাধারণ পরিস্থিতিতে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির প্রিয় মোনালিসা মাস্টারপিসটি প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার দর্শকদের আকর্ষণ করে।সারা বিশ্বের পর্যটকরা প্রতিকৃতিটির রহস্যময়, মৃদু হাসির বিষয়ের সাথে সেলফি তোলার আশায় লুভরের স্যালে দেস ইটাতে ভিড় করে৷
।। লেখক : আলী বেবুল, বৃটেনবাসি সাংবাদিক ও সংগঠক। বাংলাদেশ সেন্টার-লন্ডনের মিডিয়া কমিটির আহবায়ক।