ইমন শরীফ
___________
শবেবরাত দুইভাষার দুইশব্দের সমন্বয়ে গঠিত।
প্রথম শব্দ ‘শব’ হচ্ছে একটি ফার্সিশব্দ,তার বাংলা অর্থ ‘রাত’। দ্বিতীয় শব্দ হচ্ছে ‘বরাত’ একটি আরবিশব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘বিমুক্তকরণ’।
উভয়শব্দের সম্মিলিত অর্থ হচ্ছে”বিমুক্তকরন রাত”।
ফার্সি ‘শবে বরাত’ শব্দটির আরবি সমার্থক শব্দ হলো ‘লাইলাতুল বরাত’।
খোঁজাখুঁজি করে এ রাতটির মোট চারটি নাম পাওয়া গেছে,যথা: লাইলাতুম মুবারাকা, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুছ্ ছাক, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।
.
হাদিছ শরীফে এই রাতকে ليلة النصف من شعبان তথা মধ্যশাবানের রজনী বলা হয়েছে।
আমাদের উপমহাদেশে এটি ভাগ্যরজনী হিসেবে পরিচিত।
পবিত্র কুরআনে শবেবরাতের স্পষ্ট কোনো উল্লেখ না থাকলেও অনেকেই সূরা দুখানের তৃতীয় আয়াত انا انزلناہ فی لیلۃ مبارکۃ’র লাইলাতুল মুবারাকাহ কে শবে বরাতের দিকে ইঙ্গিত করেন,তন্মধ্যে একজন হলেন আল্লামা ইবনে কাসির (র.) তিনি বলেন, ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে বরকতময় রাতটি শাবানের মধ্যম রজনী, উল্লেখ্য হযরত ইকরিমা (রহঃ) রইসুল মুফাসসিরিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ছাত্র।তাফসীরে কাবিরের নবমখণ্ডে এআয়াতের তাফসিরে আল্লামা ফখরুদ্দীন রাজিও একথাটি বলেছেন,তিনি বলেন অধিকাংশের মতে এখানে মুবারাকা দ্বারা লাইলাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য হলেও হযরত ইকরিমা (রহঃ)সহ অনেকেই মুবারাকা দ্বারা শাবানের ১৫তারিখের রাতকে বুঝিয়েছেন। তাফসিরে রুহুল মাআনীতেও আল্লামা আলুসী(রঃ),
জামিউল আহকামিল কুরআনে ইমাম কুরতুবিও তাফসিরে বাগাওয়িতেও আল্লামা হুসাইন আল বাগাবি অনুরূপ উল্লেখ করেছেন।
তাফসিরে কাশ্শাফের চতুর্থখণ্ডে আল্লামা যামখশরী এই আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেন-
কুরআন নাজিলের সূচনা হয়েছে শাবানের পনেরো তারিখের রজনীতে,আর তার সমাপ্তি ঘটেছে কদরের রাতে।
তবে সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন তাফসিরে জালালাইনে আল্লামা সুয়ুতি (রহ),তিনি বলেন শাবানের পনেরো তারিখের রজনীতে লাওহে মাহফুজ থেকে বাইতুলইজ্জতে কুরআন নাজিল হয়েছিল,আর সেখান থেকে কদরের রাতে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর জিব্রাইল আলাইহিস সালাম কুরআন নাজিলের সূচনা করে একাধারে তেইশবছর পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
অন্যদিকে পবিত্র করআনে কদরের রাতের স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমনঃ সুরায়ে কদরের প্রথম আয়াতে আল্লাহ্ বলেন: إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ আর এই কদরের রাত, যে রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে তা যে রমজান মাসে তাও সুরায়ে বাকারার ১৮৫নং আয়াত شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَان দ্বারা স্পষ্ট।
তাই বলা যায় সুরায়ে দোখানের ৩নং আয়াতের লাইলাতুল মুবারকাহ দ্বারা পবিত্র রমজান মাসের কদরের রাত উদ্দেশ্য তাতে কোনোরকমের কোনো সন্দেহ নেই। এজন্য অধিকাংশের মতে গ্রহণযোগ্য মত হলো মুবারাকা দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কদরের রাতই উদ্দ্যেশ্য।
কিন্তু বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তাফসিরকারকদের ব্যাখ্যায়
এবিষয়টিও ফুটে ওঠেছে যে,শবেবরাতের অস্তিত্ব মোটেও অস্বীকার করার নয়।
অন্যদিকে, হাদিস জগতের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম শরিফে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান নিয়ে কোনো হাদিস পাওয়া না গেলেও সিহাহসিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে শবেবরাত সম্পর্কে একাধিক হাদিস পাওয়া যায়।
নিচে তা কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
حَدَّثَنَا عَبْدَةُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ الْخُزَاعِيُّ، وَمُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الْمَلِكِ أَبُو بَكْرٍ، قَالاَ حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَنْبَأَنَا حَجَّاجٌ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ عُرْوَةَ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ فَقَدْتُ النَّبِيَّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ذَاتَ لَيْلَةٍ فَخَرَجْتُ أَطْلُبُهُ فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ رَافِعٌ رَأْسَهُ إِلَى السَّمَاءِ فَقَالَ ” يَا عَائِشَةُ أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ ” . قَالَتْ قَدْ قُلْتُ وَمَا بِي ذَلِكَ وَلَكِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ . فَقَالَ ” إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعَرِ غَنَمِ كَلْبٍ ” .
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, এক রাতে আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি জান্নাতুল বাকিতে, তাঁর মাথা আকাশের দিকে তুলে আছেন। তিনি বলেন, হে আয়িশা! তুমি কি আশঙ্কা করেছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আয়িশা (রাঃ) বলেন, তা নয়, বরং আমি ভাবলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোন স্ত্রীর কাছে গেছেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোকের গুনাহ মাফ করেন। [১৩৮৯] ইবনে মাজা।
উক্ত হাদিসের রাবী হাজ্জাজ সম্পর্কে ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, তিনি সত্যবাদী কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়। তিনি আমর থেকে হাদিস বর্ণনায় তাদলীস করেছেন। আবু যুরআহ আর-রাযী বলেন, তিনি সত্যবাদী কিন্তু হাদিস বর্ণনায় তাদলীস করেন। আবু হাতিম আর-রাযী বলেন, তিনি সত্যবাদী কিন্তু দুর্বলদের থেকে তাদলীস করেন। আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, আমি তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে বর্জন করেছি।
হাদিসের মানঃ দুর্বল হাদিস
حَدَّثَنَا رَاشِدُ بْنُ سَعِيدِ بْنِ رَاشِدٍ الرَّمْلِيُّ، حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ، عَنِ ابْنِ لَهِيعَةَ، عَنِ الضَّحَّاكِ بْنِ أَيْمَنَ، عَنِ الضَّحَّاكِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَرْزَبٍ، عَنْ أَبِي مُوسَى الأَشْعَرِيِّ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ “ إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلاَّ لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ ” .
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ، حَدَّثَنَا أَبُو الأَسْوَدِ النَّضْرُ بْنُ عَبْدِ الْجَبَّارِ، حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ، عَنِ الزُّبَيْرِ بْنِ سُلَيْمٍ، عَنِ الضَّحَّاكِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا مُوسَى، عَنِ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ نَحْوَهُ .
আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং [১৩৯০] ইবনেমাজা। হাদিছের মান- হাসান হাদিস।
উক্ত হাদিসের রাবী ১. ইবনু লাহীআহ সম্পর্কে ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, তার হাদিসের ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই। আমর বিন ফাল্লাস বলেন, তার কিতাব সমূহ পুড়ে যাওয়ায় হাদিস বর্ণনায় সংমিশ্রণ করেন। কিতাব সমূহ পুড়ে যাওয়ায় যে হাদিস বর্ণনা করেছেন তা দুর্বল। ২. দাহহাক বিন আয়মান সম্পর্কে ইমাম যাহাবী বলেন, তিনি কে? তা অজ্ঞাত। ৩. যুবায়র বিন সুলায়ম সম্পর্কে ইমামগণ বলেন, তিনি মাজহুল বা অপরিচিত। ৪. আব্দুর রহমান সম্পর্কে ইমামগণ বলেন, তিনি মাজহুল বা অপরিচিত।
মোঠকথা সুরায়ে দুখানের মুবারাকার ব্যাখ্যায় তাফসিরকারকদের মতানৈক্যও বিভিন্ন হাদিসদ্বারা বুঝা গেল শবেবরাতের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে।
তাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
কেননা যদি তার অস্তিত্ব না থাকতো তাহলে পৃথিবী বিখ্যাত মুফাসসিরগণ তাদের তাফসিরগ্রন্থসমূহে তাকে নিয়ে এতো বিশদ আলোচনা করতেন না। একদিকে তাফসিরকারকদের বর্ণনা,অন্যদিকে বেশকয়েকটি হাদিস প্রমাণ করে অবশ্যই অবশ্যই তার অস্তিত্ব আছে।
একটি দুর্বল হাদিছও যদি কয়েকজন বর্ণনা করেন বা কয়েকটি হাদিছ গ্রন্থে তা বর্ণিত হয় সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষকরে ফজিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিছও গ্রহণযোগ্য, যদি তার বিপরীত কোনো সহীহ হাদিছ না থাকে।
অথচ শবেবরাত সম্পর্কে হাদিছগুলো অধ্যায়ন করলে দেখা যাবে কোনো কোনো হাদিছকে কেউ সহীহও বলেছেন আবার কেউ যয়িফ।
সুতরাং কুরআনের বিভিন্ন ব্যাখ্যাতার ব্যাখ্যাও বেশকিছু হাদিসদ্বারা একথা প্রমাণিত হলো যে শবেবরাত অবশ্যই আছে এবং তার অনেক ফজিলতও আছে।
কেননা শরীয়তের চার দলিলের ২য়টি হচ্ছে হাদিছ। কুরআনে স্পষ্ট না থাকলেও বেশকয়েকটি হাদিছ চাহে তা সহীহ হোক বা যয়িফ যেহেতু শবেবরাত সম্পর্কে আলোকপাত করে,তাই শবেবরাতের অস্তিত্বে কারো প্রশ্ন তুলার অবকাশ নেই।
ফলে নিঃসন্দেহে বলা যায়,শবেবরাত ফজিলতময়। শবেবরাতে যথাসাধ্য নফলি আমলে বাধার কোনো যৌক্তিকতা আমি কোথাও খুঁজে পাই না। শবেবরাতের অস্তিত্বেও বিতর্কের কিছু খুঁজে পাই না। শবেবরাত হোক নাজাতের একটি উছিলা।
আমিন।
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক