বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এর্নেস্তো কার্দেনাল : যে যাজক বিপ্লবী, যে বিপ্লবী কবি




মূল: ইলিয়াস ই. লোপেজ
তর্জমা: কামরুল হাসান

লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে প্রশংসিত কবি ও ধর্মগুরুদের একজন রেভারেন্ড এর্নেস্তো কার্দেনাল, যিনি ১৯৮০ সালে নিকারাগুয়ার বিপ্লবী স্যান্ডিনিস্টা সরকারে যোগ দিয়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চকে অস্বীকার করেছিলেন, তিনি গত রবিবার( ১ মার্চ ২০২০) নিকারাগুয়ার মানাগুয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫।

নিকারাগুয়ার এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল নিকারাগুয়ার বিপ্লবের একজন শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন দরিদ্রদের উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিবেদিত মার্ক্সবাদী নীতিমালায় প্রোথিত খ্রিস্টিয় আন্দোলন- ‘স্বাধীনতাকামী ধর্মতত্ত্ব’-এর একজন একনিষ্ঠ প্রবক্তা। ১৯৭৯ সালে সান্ডিনিস্টা গেরিলারা একনায়ক জেনারেল আনাস্তাসিও সমোজা ডিবেলিকে উৎখাতের পর ফাদার কার্ডেনালকে
নিকারাগুয়ার প্রথম সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আশির দশকে পোপ দ্বিতীয় জন পলের নেতৃত্বে ‘স্বাধীনতাকামী ধর্মতত্ত্বের’ বিরুদ্ধে ভ্যাটিকানের অবস্থান কঠোর হলে ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯৮৩ সালে নিকারাগুয়ায় এক নির্ধারিত সফরের আগে পোপ জনসমক্ষেই ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল এবং আরো চারজন ধর্মযাজক যারা সক্রিয়ভাবে বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদের সরকারি পদ ছেড়ে দেবার আহবান জানিয়েছিলেন। সান্ডিনিস্টা সরকার পোপের এই দাবীকে অগ্রাহ্য করে কিন্তু একথা জানায় যে পোপের প্রতি তাদের আমন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে।

কয়েক মাস ধরে জনবিতর্ক চলার পরে পোপ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়াতে পদার্পণ করেন। বিমানবন্দরের টারম্যাকের উপর দিয়ে অপেক্ষমান উপস্থিত অভ্যর্থনাকারীদের সাথে করমর্দন করে হেঁটে যাবার সময় মান্যগণ্যদের কাতারে ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল দেখে পোপ যারপরনাই বিস্মিত হন। যখন অন্যান্য ধর্মযাজকগণ তাদের প্রথাগত ধর্মীয় পোষাকে আচ্ছাদিত ছিলেন, তখন ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল একটি কলারবিহীন সাদা শার্ট, ঢোলা প্যান্ট আর ঘন সাদা চুলের উপর তার বৈশিষ্ট্যসূচক কালো টুপি পরে ছিলেন। তিনি যখন হাঁটু মুড়ে বসে পোপের আঙটিতে চুমু খেতে উদ্যত হলেন, তখন পোপ তার হাত সরিয়ে নেন এবং তার দিকে আঙুল তুলে বেশ কঠিনভাবে কথা বলেন। ভ্যাটিকানের একজন কর্মকর্তার বরাতে এসোসিয়েটড প্রেস জানায়, পোপ ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল বলেছিলেন, “আপনার উচিৎ চার্চের সাথে আপনার সম্পর্ক ঠিক করে নেওয়া।”

১৯৮৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল বলেছিলেন, “যিশু, তুমি আমাকে মার্ক্সের পথে নিয়ে চলো।” “আমার মনে হয় না পোপ মার্ক্সবাদ বোঝেন। আমার কাছে চারটি গসপেলই (ধর্মীয় বিধান) সমানভাবে কমিউনিস্ট। আমি এমন একজন মার্ক্সিস্ট যে খোদাকে বিশ্বাস করে, অনুসরণ করে যিশুকে, আর তার সাম্রাজ্যের স্বার্থেই একজন বিপ্লবী।”

একই বছরে নিকারাগুয়ার বিশপ তার যাজকসুলভ কতৃর্ত্ব খর্ব করে (একইসঙ্গে আরও তিন যাজককে শাস্তি দেওয়া হয়)। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাদার কার্দেনালের উপর অরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় যখন পোপ ফ্রান্সিস সকল আনুশাসনিক সেন্সরশীপের উপর তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অনুমোদন প্রদান করেন।

নিকারাগুয়া ও লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত ইতিহাসকে উপলক্ষ করে ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল যুবক বয়স থেকেই ব্লাঙ্ক ভার্সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। যদিও তার বেশিরভাগ কবিতা বেশ অন্তরঙ্গ ভাবের, যুবক বয়সের আবেগ ও হাহাকার সমৃদ্ধ প্রেমের কবিতা, সন্ধ্যায় নগরের বাতির চমৎকার সব উপমাখচিত, কিংবা তার বিখ্যাত কবিতা ‘মেরিলিন মনরোর জন্য প্রার্থনা’ যাতে তিনি বর্ণনা করেন ১৯৬২ সালে মনরোকে কীভাবে তার মৃত্যুশয্যায় পাওয়া গিয়েছিল, “যেন গুন্ডাদল দ্বারা আহত কোন একজন/একটি সংযোগহীন টেলিফোনের দিকে প্রসারিত যার হাত।”

অভিলব্ধ রাজনৈতিক শিক্ষা ও বিবর্তনবাদের দ্বারা মোহিত হয়ে, আশির দশকে ফাদার কার্দেনাল তাঁর কবিতায় বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেন। মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও মানব কোষের ডিএনএ-র রহস্য দ্বারা মোহিত হয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত
এই বিষয়কে কবিতায় বিকশিত করেন। তাঁর কাব্যিক অবলোকনের ভিতর দিয়ে এইসব বিস্ময়ের উৎস জনগণকে ঈশ্বরের সন্নিকটে আনে।

২০১৪ সালে স্প্যানীয় ভাষায় প্রকাশিত ফাদার কার্দেনালের কাব্যসংগ্রহ নব্বইয়ে নব্বই-র ভূমিকায় নিকারাগুয়ার লেখক সের্হিও রামিরেস লেখেন, “তাঁর বিপুলায়তন দৃষ্টিতে সবকিছুই একীভূত ও ঘণীভূত হয়।” “কেমলমাত্র কবির নিজস্ব অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা ও স্বর্গের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এক রহস্যময় জগতে প্রবেশ করে না, সেইসাথে তার নিজের অতীত স্মৃতিমালাও সেখানে গ্রথিত হয়ে যায়।”

ফাদার কার্দেনালের কবিতার ইংরেজি অনুবাদের সবচেয়ে সাম্প্রতিক ও পরিপূর্ণ সংগ্রহটির নাম ‘বহুলবিশ্ব : নতুন ও নির্বাচিত কবিতা‘ (২০০৯, জোনাথান কোহেন সম্পাদিত)।

এই কাব্যসংগ্রহের শেষ কবিতাটি ছিল ‘নক্ষত্রধূলি’, মৃত্যু নিয়ে ফাদার কার্দেনালের ধ্যানমগ্ন উচ্চারণ। এটি সমাপ্ত হয় এইরূপে:

“আর ছায়াপথ একটি ফুলের আকারে ফুটছিল
এই নক্ষত্রখচিত রাতে তাকে তেমনি দেখা গেল
আমাদের হাড়, আমাদের পেশি এসেছে অন্য নক্ষত্রজগৎ থেকে
এবং সম্ভবত অন্য কোন ছায়াপথ থেকে,
আমরা তো মহাবৈশ্বিক,
এবং মৃত্যুর পরে আমরা অন্য নক্ষত্র গঠনে লেগে যাবো
এবং অন্য কিছু ছায়াপথ নির্মাণে।
নক্ষত্র থেকেই আমাদের আগমন আর আমরা ফিরে যাই নক্ষত্রলোকেই।”

এর্নেস্তো কার্দেনাল মার্তিনেস লেক নিকারাগুয়া সংলগ্ন একটি শহর গ্রানাডায় ১৯২৫ সালের ২০ শে জানুয়ারি একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মানাগুয়াতে ও নিউ ইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য অধ্যয়ন করেন, যেখানে তিনি ওয়াল্ট হুইটম্যান, এমিলি ডিকিনসন ও এজরা পাউন্ডের কবিতার স্বাদ লাভ করেন।

তিনি ১৯৫০ সালে নিকারাগুয়া ফিরে আসেন, কিন্তু সমোজা পরিবারের বিরুদ্ধে একটি অভুত্থান ব্যর্থ হলে তিনি পালিয়ে আমেরিকা চলে যান। সেখানে কেনটাকির ট্রাপিস্ট উপাসনালয় গেথেসমানিতে যোগ দেন এবং আমেরিকান লেখক ও ধর্মযাজক থমাস মেরটনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। নিকারাগুয়া ফিরে এলে তাকে গির্জার পাদ্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

উনিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে নিকারাগুয়ায় আমেরিকান দখলদারিত্বের বিপক্ষে গেরিলা যুদ্ধ চালানো নিকারাগুয়ান বীর ও বিপ্লবী আউগুস্তো সেসার সানদিনো, যাকে ১৯৩৪ সালে হত্যা করা হয়, তার নামে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত সান্দিনিস্টা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের গোড়া থেকেই ফাদার কার্দেনাল এর সমর্থক ছিলেন।

ষাটের দশকে বিপুল আয়তনের লেক নিকারাগুয়ার দক্ষিণ সীমান্তের নিকটবর্তী সোলেনটিনেম দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে আস্তানা গেড়ে তোলার পর তিনি তার লক্ষ্যে আরও এগিয়ে যান। তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের সাহিত্য ও চিত্রকলার উপর শিক্ষা দেন।

তার কবিতা ক্রমশ স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। তিনি যাকে বলেছেন “তীক্ষ্ণ ব্যঞ্জনামূলক উক্তি ” – স্বৈরাচারী সমোজা সরকারের বিরুদ্ধে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্যের সাথে ভালোবাসা ও বিরহের মিশ্রনে রচিত ছন্দোবদ্ধ উচ্চারণ তাকে পরিচিত করে তুলতে থাকে। এমনি একটি কবিতাতে তিনি লেখেন,

আমি গোপন বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছি
চীৎকার করে বলছি : স্বাধীনতা দীর্ঘজীবি হোক! সড়কের মাঝখানে
সশস্ত্র প্রহরীকে অগ্রাহ্য করে।
আমি এপ্রিল বিদ্রোহে যোগ দিয়েছি:
কিন্তু আমি বিবর্ণ হয়ে যাই যখন তোমার বাড়ির পাশ ঘেষে যাই
তোমার একটি চাহনি আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দেয়।

তার ধর্মীয় উপদেশাবলী, ছিল রাজনৈতিক, সমোজা শাসনের পতন কামনায় পূর্ণ। তার কিছু শিক্ষার্থী গেরিলা দলে যোগ দেয় আর দ্বীপটি হয়ে ওঠে সান্দিনিস্টা আন্দোলনের সামরিক প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার কাল, গেরিলা প্রতিরোধ ও রাজধানীতে গণঅপহরণ অপারেশনের পরে সান্দিনিস্টরা ১৯৭৭ সালে নিকারাগুয়ার ক্ষমতায় এলে, গেরিলা নেতা দানিয়েল ওর্তেগা, ফাদার কার্দেনালকে সান্দিনিস্টা সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেন।

সরকারের মন্ত্রী হিসেবে ফাদার কার্দেনাল চেয়েছিলেন, যাকে তিনি বলেন, “সংস্কৃতির গণতান্ত্রিকরণ” করতে। নিকারাগুয়ার সমৃদ্ধ কাব্য ঐতিহ্যকে, যার অন্তর্গত উনবিংশ শতকের শেষভাগে লাতিন আমেরিকায় আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা রুবেন দারিও, আংশিক অনুসরণ করে তিনি দেশব্যাপী কবিতার কর্মশালা গড়ে তোলেন।

কিন্তু ফাদার কার্দেনালের সমালোচকরা বলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে কন্ট্রা নামে পরিচিত আমেরিকা সমর্থিত প্রতিবিপ্লবী শক্তির বিরুদ্ধে সান্দিনিস্টাদের দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের সময়ে,
একধরণের আদর্শিক সাযুজ্য চাপিয়ে দিচ্ছিল, যা নতুন লেখকদের উপর প্রচারণামূলক লেখা লিখতে চাপ সৃষ্টি করেছে।

১৯৮৭ সাল পর্যন্ত, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অন্য একটি সরকারি সংস্থার সাথে একীভূত করার আগ পর্যন্ত ফাদার কার্দেনাল নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি নিজেকে সান্দিনিস্টা সরকার থেকে সরিয়ে নেন, এবং ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে বসা দানিয়েল ওর্তেগাকে ক্রমশই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার সমালোচনা করেন। ফাদার কার্দেনাল মনে করতেন সান্দিনিস্টা বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে।

কিন্তু তিনি তাঁর মার্ক্সবাদী আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাবান থাকেন।

২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ফাদার কার্দেনাল বলেছিলেন “আমি একজন বিপ্লবী”। “বিপ্লবী মানে হলো আমি এই দুনিয়াটিকে বদলাতে চাই।”

তিনি এর সাথে যোগ করেন : “বাইবেল বিপ্লবে ঠাসা। নবীরা হলেন বিপ্লবের বাণী বহনকারী মানুষ। নাজারেথের যিশু নবীদের বিপ্লবী বার্তাগুলো গ্রহণ করেন। আর আমরাও বিপ্লব ঘটাতে ও দুনিয়াকে বদলাতে চেষ্টা করে যাব। পুরনো বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু নতুন বিপ্লব আসবে।”

(দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১ মার্চ ২০২০ সালে প্রকাশিত Ernesto Cardenal, Nicaraguan Priest, Poet and Revolutionary, Dies at 95 শীর্ষক প্রবন্ধের বাংলা তর্জমা)

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: