মিজান মোহাম্মদ :
নগরীর বেসরকারী প্রতিষ্টানের কর্মকর্তা আশরাফ আলী প্রতিদিন ঘুম থেকে সকাল সাতটার মধ্যেই ওঠে পরেন। ঘুম থেকে ওঠেই বাথ্রুমে গিয়ে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসেন নিউজ পেপার নিয়ে। দেশের খবর, সমাজের খবর, বিশ্বের খবর পড়তে পড়তেই সেরে নেন সকালের নাস্তা । তারপর রেডি হন অফিসের জন্য। অফিসের অবসরে বা রাতে বাসায় এসে আবার খবরের কাগজ হাতে নেন। কিন্তু প্রায় দুইমাস ধরে তার নিয়মিত অভ্যাসে বাঁধ সাধে নোবেল করোনা ভাইরাস।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে গত ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে, ১০এপ্রিল থেকে চলছে লকডাউন। হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা বাদে দেশের প্রিন্ট মিডিয়া স্থবির হয়ে আছে। তাই আশরাফ আলী চাইলেই পত্রিকা পড়তে পারেন না। তবে আশরাফ আলীর এই শূন্যতা দূর করতে তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে লিওজা মোবাইলে দুইটি নিউজ পোর্টালের নোটিফিকেশন অন করে দিয়েছে। ফলে ডাটা অন করা থাকলে পত্রিকায় কোন নিউজ আপডেট করার সাথে সাথে নিউজের শিরনামসহ নোটিফিকেশন চলে আসে। সুবিধামতো যে কোন সময় তিনি নিউজটি পড়ে নিতে পারেন।
সারাদেশের মতো সিলেটের স্থানীয় পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা বন্ধ রয়েছে ২৬ মার্চ থেকে। ২৪ মার্চ স্থানীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকবৃন্দের এক বৈঠক থেকে পত্রিকা প্রকাশনা থেকে বিরত থাকার এই সিদ্বান্ত গ্রহণ করা হয়। ফলে ২৬ মার্চ থেকেই হকারশুণ্য সিলেট। পত্রিকার শিরোনাম নিয়ে এখন আর হাঁক ডাক নেই হকারদের। যারা বাসায় গৃহবন্দী তাদের বাসায়ও পত্রিকা নিয়ে কড়া নাড়ছেনা কোনো হকার। সিলেটে স্থানীয় ও জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকার এই শুন্যতা এখন পুরণ করছে স্থানীয় অনলাইন গণমাধ্যম। প্রতিদিন করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
অধিকাংশ অনলাইন পোর্টালে কোন বিজ্ঞাপন নেই। নেই কোন অন্য আয়। প্রকাশক বা সম্পাদকদের আয় না থাকায় নাম মাত্র বেতনে এই মাধ্যমে কাজ করছেন সিলেেেটর প্রায় ৫শ’র অধিক সংবাদকর্মী। আর এই নাম মাত্র বেতনে হাতে পেতে একদল সংবাদ কর্মী জীবনের পরোয়া না করে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। কাজ করে যাচ্ছেন এই করোনা কালেও। কিন্তু ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না, না পাচ্ছেন প্রণোদনার আশ্বাস। অবহেলা-অভাব আর করোনার সাথে লড়াই করে কাজ চালিয়ে যাওয়া এ্মন সংবাদ কর্মীদের সংখ্যা সিলেট নগরীতে হাজারের কম হবে না।
ফিরোজ হাসান। কাজ করেন সিলেটের একটি প্রিন্ট পত্রিকায়। বেতন নেই দু’মাস ধরে। সেই সময়টি ব্যয় করছেন এখন স্থানীয় একটি অনলাইনে। একই অবস্থা সেখানেও। মাসাধিকাল কাজ করার পরও সম্পাদকের সহানুভতি ছাড়া আর কিছুই পাননি। নগরীতে একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে তিনি এখন সিকিপেটায় চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। কারো কাছে হাত পাততেও যথেষ্ট আপত্তি। বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহায়তাও নিতে পারছেননা সম্মানের দিকে তাকিয়ে। এই অবস্থা শুধু ফিরোজ হাসানের নয়-কথা বলে সিলেটের অন্তত দুইশ’ সংবাদকর্মী এমন তথ্য জানিয়েছেন প্রতিবেদকের কাছে।
সিলেট শুরুর দিকের একটি অনলাইন পোর্টালের নাম সিফডিয়া। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন হয়ে পোর্টালটি সিলেট এক্সপ্রেস টোয়েন্টিফোর ডটকম নামে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। পোর্টালটির উপদেষ্টা সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক ও গল্পকার সেলিম আউয়াল। জানতে চাইলে তিনি সিলেট প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিলেট এক্সপ্রেসে কর্মরত সংবাদ কর্মীর সংখ্যা ৮ জন। এর মধ্যে ২ জন ফটোগ্রাফার ছাড়াও এখানে কাজ করছি আমরা তিন ভাই। সিলেটে অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রকাশে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেননা। ফলে কোনো ইনকাম সোর্স ছাড়াই চলছে অধিকাংশ পোর্টাল। এ অবস্থায় নিজেদের সম্মানী নেয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও স্টাফদের সম্মানী প্রদান করাটা মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে সেই পরিস্থিতি’। তিনি বলেন, যেখানে পরিবার নিয়ে নিজেরাই হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে কর্মরত সাংবাদিকদের বেতন দেবো কোথা থেকে ?
সিলেটের একটি অন্যতম পোর্টাল সকালের খবর টোয়েন্টিফোর ডটকম। এর প্রকাশক একজন সিনিয়র সংবাদকর্মী সিরাজুল ইসলাম। সিলেট প্রতিদিনকে তিনি জানালেন অনলাইন পোর্টালগুলোর দৈনদশা। নিজের পোর্টাল বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফটোগ্রাফারসহ সকালের খবরে কাজ করেন ৮ জন। এর মধ্যে ২৬ মার্চ স্থানীয় দৈনিকগুলো বন্ধ হবার পর যুক্ত করা হয়েছে নতুন তিনজন। করোনাকালে প্রতিটি মুহূর্তেই গৃহবন্দী পাঠকদের সংবাদ দ্রুত আপডেট দিতে এই মাধ্যমটি এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কাজের বিপরীতে এই ৮ জন স্টাফের মাসিক সম্মানী প্রদান করা আমার মতো ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনা।’ তিনি বলেন, ঢাকায় সংবাদকর্মীদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু সিলেটে এখনও এ বিষয়ে উপেক্ষিত রয়েছেন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা। তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এই অবস্থা শুধু সিলেট এক্সপ্রেসের নয়। সিলেটে রয়েছে প্রায় শতাধিক পোর্টাল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অনলাইনে কর্মরত সংবাদকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১০ জনের মতো করে। স্থানীয় প্রিন্ট পত্রিকাগুলোর অথিকাংশের মালিক ধণাঢ্য হলেও অনলাইন পোর্টালগুলোর সম্পাদক/প্রকাশকদের আর্থিক অবস্থা অনুল্লেখযোগ্য। ফলে রীতিমতো হিমশিম খেয়েই তাদেরকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য মানবিক কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক সিলেট টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক কবি মুহিত চৌধুরী বলেন, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের আওতাধীন পোর্টালের সংখ্যা ৩৫ টি। করোনাকালীন দুর্যোগে অনলাইন গণমাধ্যমই এখন পাঠকদের একমাত্র অবলম্বন। বিশেষ করে সিলেটে অঞ্চলে করোনার সার্বিক পরিস্থিতি, আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা দ্রুত আপডেট দিচ্ছে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো। তাছাড়া, করোনা ঝুঁকি মোকাবেলায় সতর্কতামুলক সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যম পাঠকদের কাছে এখন অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সারাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের কর্মীরা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য করোনা মোকাবেলায় দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ সদস্যদের জন্য সরকার প্রণোদনার ঘোষণা দিলেও সিলেটের অনলাইন গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য অনুরূপ কোনো ঘোষণা দেননি। তিনি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার জন্য সিলেটের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি কামনা করেন।
অধিকাংশ পাঠক জানালেন, ঘরে বসে বসে মোবাইলে নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে দেশ ও দশের খবর নিচ্ছেন এমন পাঠকের সংখ্যা প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ঘটনার সাথে সাথেই সংবাদ, হাতে হাতেই সংবাদ, দিনে রাতে সংবাদ, যেখানে সেখানে সংবাদ, যার তার হাতে সংবাদ। আর এমন করে সংবাদ সবার কাছে একেবারে নামমাত্র খরচে পৌছে দিতে ভূমিকা রাখছে এই অনলাইন পোর্টালগুলো।
অন্য দিকে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় আইইডিসিআর। এর ১০ দিন পর করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় দেশে। মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মোট ২৫০ জনের মৃত্যু হল। মহামারী করোনাভাইরাস কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আক্রান্তের খবর আসছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বের এই ক্রান্তি লগ্নে কাজ করে যাওয়া চিকিৎসক, সংবাদকর্মী, ব্যাংকার ও পুলিশ । মারাও যাচ্ছেন অনেকেই।