বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চেতনায় সারাবেলা




মোহাম্মদ আব্দুল হক

বাংলাদেশ পুরোটাই আমার। শত শত নদী তার। এরই মাঝে আছে নদী একটি যা বড় বেশী আমার। আর সুনামগঞ্জ আমার তবে যাবো যেখানে দরকার। এই সিলেট সে-তো আমার। অবশ্য ১৯৪৭ খ্রীষ্টিয় সালে ভারত ভাগের সময় রেডক্লিফ এর হিসাব আমলে আনলে জানি, বৃহত্তর সিলেটের লাগোয়া আসাম ও করিমগঞ্জ আমাদের থাকার কথা।

সে যাই হোক আমি রইবো যেখানে দরকার। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, দেখার হাওর সহ বহু হাওর ও বিল শত শত প্রজাতির মাছের বাড়ি। এখানে মাছরাঙা টুপ করে মাছ ধরে গলধকরণ করে। আর আমাদের শীত ঋতুতে এই সমস্ত হাওর ও বিল দূর সাইবেরিয়া থেকে আসা লক্ষ লক্ষ পাখিদের আশ্রয় ও খাদ্য দেয় পরম মমতায় ও উদারতায়। এই সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ সরকারী মহাবিদ্যালয় হলো আমার বিদ্যালয়। সিলেট এম সি কলেজ আমার কলেজ। প্রায় শত বৎসরের ঐতিহ্য, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট, আমার বিদ্যাপীঠ।

এই বাংলাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্য পত্রিকা যার প্রথম প্রকাশ ১৯৩২ খ্রীষ্টিয় সালে ‘আল-ইসলাহ ‘ আমাদের সাহিত্যাকাশে গৌরবের চিহ্ন। শহীদ জগৎ জ্যোতি পাঠাগার সুনামগঞ্জ আমাকে শিখায় অনেক। আমার হাসন রাজার গান আমাকে ভাবিয়ে তোলে জীবনের মানে খুঁজতে। এই বাংলার এই উর্বর জমিনে জন্ম নেয়া রাধারমণের গান যেন সকল যুগের মানুষের মনের গভীরতম প্রেমকে নিত্য বয়ে চলেছে। শাহ আব্দুল করিমের গান আমার যুগ যুগের সংস্কৃতির সাথে আমাকে সব সময় পরিচয় করিয়ে রাখে। সুনামগঞ্জে জন্ম নেয়া সিলেটের এক বীর সন্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল এম এ জি ওসমানী আমাদের সাহসী চেতনা। শ্যামল বাংলার সিলেটের সবুজ প্রকৃতির সদা চঞ্চল প্রাণ কাঠবিড়ালির চঞ্চলতা আমাকে বড় হতে দেয়না, বারেবারে দেখি আর শিশুর মতো আনন্দিত হই। হযরত শাহজালাল র. মাজারের ‘ ঝাঁকে উড়ে আকাশ জুড়ে জালালি কৈতর’, আহা! কি চমৎকার ডানা ঝাপটিয়ে কবুতরের উড়ে চলা আর ডিগবাজী দিয়ে আবার নেমে আসা। সুনামগঞ্জের ধান ফসলের মাঠ, হাওর আমাকে কবি করে বাঁচিয়ে রাখে শত যন্ত্রনা ভুলিয়ে। সুনামগঞ্জ শহরের পাশে বয়ে চলা সুরমা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মেঘের বাড়ি মেঘালয় দেখে মন ভরে উঠে এক পরম পাওয়ায়।

আমার আকাশে মেঘের পাহাড় উড়ে বেড়ায়, বৃষ্টি ঝরে, আবার রোদ উঠলে আলোয় অবগাহন করি। আমি জানি এমন প্রকৃতির কোলের সন্তান মানুষ প্রকৃতিগত প্রকৃষ্ট চরিত্রের। যা কিছু অসৎ তা দুষ্টজন আর অপসংস্কৃতির প্রভাব। আমার বাংলা সাহিত্যের দুই মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম সিলেটের প্রকৃতি ও সংস্কৃতিতে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। সিলেটের চা বাগান যেন সবুজ চাদরে পরম মমতায় ঢেকে রেখেছে ছোট আর মাঝারি অনেক অনেক পাহাড়কে যা আমাকেও করেছে অমোঘ প্রকৃতি প্রেমিক। সুরমা প্রিয় নদী আমার। আমার যতো প্রেম সুনামগঞ্জ ঘিরে, সুরমার জল ছুঁয়ে। আমার প্রথম কবিতা, আমার প্রথম নাটকের শহর সুনামগঞ্জ।

আমার প্রথম প্রতিবাদী মিছিলের শহর সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ শহরের অলিগলিতে একাকী হেঁটেছি আর কুড়িয়েছি অনেক, আর দিতে পারলাম কিছুইনা। বন্ধুদের সাথে ছুটেছি সীমাহীন ভালোবাসা ও ভরসায়। আমার পূর্ব কয়েক পুরুষের গ্রাম যা আমার জন্মগ্রাম হরিনাপাটি, অ আ ক খ এর হাত ধরে বেড়ে উঠা শহর সুনামগঞ্জ এবং সময়ের প্রয়োজনে আমার বসবাস স্থান সিলেট শহর সুরমা ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার জল পান করে ভাঙা গড়ার খেলা খেলে চলেছে শত সহস্র বছর ধরে। আমার শিকড় প্রোথিত সুরমার জলে লালিত হরিনাপাটি, সুনামগঞ্জ ও সিলেট এর গভীরে। টিকে থাকুক হরিনাপাটি, টিকে থাকুক আমার সুনামগঞ্জ, টিকে থাকুক ‘বরেণ্য ব্যক্তিত্বে ধন্য সিলেট’। আমাদের গান আর সুর আমার মনে জাগায় সারাবেলা সিলেটী চেতনা। সুরমার দুই কূলের মাটির গন্ধ আমার খুব চেনা। বাংলা সাহিত্যের কবি মধুসূদন বলেছিলেন, ‘ আমি বাঙ্গাল, আমার বাটী যশোহর।’ আমার চেতনায় সারাবেলা জাগ্রত, আমি সুনামগঞ্জী, আমি সিলেটী, আমি বাঙালি, আমি বাংলাদেশী। এই আমার খাল, বিল, নদী, হাওর, মাঠ, টিলা, পাহাড়, সমতল, স্রোতধারা, মাছ, গাছ, পাখি, ফড়িং আর ফসল বেঁচে থাকুক মানুষের কল্যাণী হয়ে। আমি বাঙলার সুরমা পাড়ের বাঙালি। টিকে থাকুক আমার ‘প্রেমিকা সুরমা ‘। সুরমার বাঁকে বাঁকে আছে আমার চিহ্নটুকু।।

মোহাম্মদ আব্দুল হক: কলামিস্ট, কবি ও প্রাবন্ধিক।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: