শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

Sex Cams

ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হউক আমাদের কোরবানি




মোঃ শামছুল আলম

আরবী কুরবান শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে কোরবানি রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ নৈকট্য। আর কুরবান শব্দটি কুরবাতুন শব্দ থেকে উৎপন্ন। আরবী কুরবাতুন এবং কুরবান উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় কোরবানি ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য পশু জবেহ করা হয়।
ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। মুসলিম উম্মাহর সার্বজনীন দু’টি উৎসবের অন্যতম একটি এই ঈদ। ঈদুল আযহার প্রধান আকর্ষণ পশু কোরবানি করা।

নিজের অর্থে কেনা পশুটি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে জবাই করার মাধ্যমে একজন প্রকৃত মুসলমান মূলত নিজেকে আল্লাহর কাছে সমপর্ণের শিক্ষা নেয়।

কুরবানী কেনঃ কুরবানী একটি অন্যতম ইবাদত। ইসলামী বিধানে ইবাদত তিন রকম। একটি শারীরিক, অন্যটি আর্থিক আর তৃতীয়টি আর্থিক ও শারীরিক। সালাত ও সিয়াম যেমন শারীরিক ইবাদত তেমনি জাকাত ও কুরবানী হলো আর্থিক ইবাদত। তৃতীয় ইবাদত হলো আর্থিক ও শারিরিক যেমন হজ্জ। যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ আছে তারা শারীরিক ইবাদতের পাশাপাশি আর্থিক ইবাদতেও সমান যত্নবান হবেন এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। এই লক্ষ্যেই আল্লাহ কুরবানীর বিধান নাজিল করেছেন।

কোরবানির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ দুনিয়ায় মানব বসতির শুরুতেই কোরবানির প্রচলন শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা ও নবী হজরত আদম (আ.) এর প্রথম সন্তান কাবিল ছিল আল্লাহ তায়ালা ও পিতা-মাতার অবাধ্য বা কাফের। কাবিলের ছোট ভাই হজরত আদম (আ.) এর দ্বিতীয় ছেলে হাবিল ছিল আল্লাহভীরু ও মু’মেন। সে সময় আল্লাহ তায়ালার হুকুমে জোড়া জোড়া সন্তান হতো। একজন পুত্র ও একজন কন্যা সন্তান। আল্লাহ তায়ালার বিধান মতো প্রথম জোড়ার পুত্রের সাথে দ্বিতীয় জোড়ার কন্যার বিয়ে বৈধ ছিল। কাবিল আল্লাহ তায়ালার বিধান মানতে রাজি ছিল না। সে চেয়েছিল তার জোড়ার সুন্দরী বোনকেই বিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত তাদেও দু’জনকে কোরবানি পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো। আর বলা হলো যার কোরবানি কবুল করা হবে সে-ই প্রথম জোরার সুন্দরী বড় বোনকে বিয়ে করবে।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে-

‘(হে নবী!) আপনি এদের কাছে আদমের দুই সন্তানের গল্পটি যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন; গল্পটি ছিলো, যখন তারা দু‘জনে আল্লাহর নামে কোরবানি পেশ করলো, তখন তাদের মধ্যে একজনের (হাবিলের) কাছ থেকে কোরবানি কবুল করা হলো, আর একজনের (কাবিলের) কোরবানি কিছুতেই কবুল করা হলো না, যার কোরবানি কবুল করা হয়নি সে বললো আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করবো, সে (যার কোরবানি কবুল করা হলো) বললো, আল্লাহ তায়ালা তো শুধু পরহেজগার লোকদের কাছ থেকেই কোরবানি কবুল করে থাকেন’(আল মায়েদা-৫-২৭)।

আল্লাহ তায়ালার আইন অমান্য করার কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটায় পিতা-মাতার  অবাধ্য সন্তান আল্লাহর দ্বীনের শত্রু“, দুনিয়ায় শয়তানের প্রথম শিকার কাফের ‘কাবিল’। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম আল্লাহর আইন, বিধান বা দ্বীন অমান্য করা আর মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটালো আল্লাহর দ্বীনের শত্রু“ কাফের ‘কাবিল’। এটাই হচ্ছে নাস্তিক, কাফের ও শয়তানের কাজ, যা আল-কুরআনের সূরা আল মায়েদাসহ আরো কয়েকটি সূরায় উল্লেখ আছে। পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস ও হত্যার ঘটনা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।

আজকে মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর দেখানো পথ বা সুন্নাত। হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তাঁর সে কলিজার টুকরা হজরত ইসমাইল (আ.) এর কোরবানির সূত্র ধরে আজও কোরবানি প্রচলিত আছে।

কোরবানির ফজিলতঃ হাদিসের  কিতাবগুলোতে কোরবানির ফজিলত সংবলিত বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। প্রিয় নবীজীর (স.) জীবন সঙ্গিনী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তান কোরবানির দিন যত নেক আমল করে তার মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হচ্ছে (পশু কোরবানির মাধ্যমে) রক্ত প্রবাহিত করা। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু (জীবিত হয়ে) তার শিং, খুর এবং পশম সহকারে উঠবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয়ে যায়।
সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা! অন্তরের খুশির সঙ্গে তোমরা কোরবানি কর’ (তিরমিজি’ ইবনে মাজাহ)। অপর হাদিসে কোরবানির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত সাহাবি হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, একদিন সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! এই কোরবানি কি? হুজুর (সা.) উত্তর দিলেন, তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নাত (নিয়ম)। তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, হে রাসূল! এতে আমাদের জন্য কি রয়েছে?  হুজুর (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকি রয়েছে।

তারা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, হে রাসূল (স.)! পশমওয়ালা পশুদের (অর্থাৎ যেসব পশুর পশম বেশি হয় যেমন ভেড়া ইত্যাদির) পরিবর্তে কি সওয়াব পাওয়া যাবে?  হুজুর (সা.) বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকি রয়েছে (চাই পশম যত বেশিই হোক না কেন)। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ)।

প্রিয়নবী (সা.) বলেন, `হে লোক সকল! জেনে রাখ তোমাদের প্রত্যেক (সামর্থ বান) পরিবারের পক্ষে প্রতি বছরই কোরবানি করা আবশ্যক’। (আবু দাউদ, নাসায়ী)

সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ কোরবানি না করে তাহলে তার জন্য রয়েছে কঠিন পরিণতি। বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলে পাক (সা.) বলেন-

‘যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না সে যেন ঈদগাহের কাছেও না আসে’। (ইবনে মাজাহ)

কুরবানীর জন্য নিয়তঃ কুরবানীর জন্য নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়ত সহিহ না হলে কুরবানী হবে না। ইসলামের যে কোন ইবাদতই এই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। কুরবানীর সূচনাই হয়েছে নিয়তকে কেন্দ্র করে। নিয়ত সহিহ হলে কুরবানী আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়, নিয়ত সহিহ না হলে আল্লাহ কারো কুরবানী কবুল করেন না। কাবিলের কুরবানী আল্লাহ পাক কবুল না করার কারণ ছিল সহিহ নিয়তের অভাব। সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-

আর তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা ঠিকমত শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুই জনেই কুরবানী করলো, তখন তাদের একজনের কুরবানী কবুল হলো, আর অন্য জনের কুরবানী কবুল হলো না।

কুরবানী কাদের ওপর ওয়াজিবঃ কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য প্রয়োজন নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা। জাকাতের মত নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ এক বছর ধরে কারো কাছে জমা থাকা এ ক্ষেত্রে জরুরী নয়। মাসয়ালা হচ্ছে, ১০ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়।

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য আরো যে সব শর্ত প্রযোজ্য তা হল, যিনি কুরবানী দেবেন তাকে হতে হবে মুসলমান ও সুস্থ-মস্তিষ্কের মানুষ। তাকে হতে হবে বালেগ এবং পূর্ণ বয়স্ক। তাকে হতে হবে মুকীম, মানে মুসাফির নন এমন ব্যক্তি।
মুসাফিরের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। কোন মহিলা নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব। কুবরানীর ব্যাপারে নারী ও পুরুষে কোন পার্থক্য নেই। সক্ষম সবার জন্যই কুরবানী ওয়াজিব।

পরিশেষে বলব,  মুসলমানদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বিশ্ব মানবতার শান্তি ও কল্যাণের জন্য সবাইকে উৎসর্গিত ও নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক শক্তি ও চিন্তা-চেতনাকে কোরবানি করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানি জীব-জানোয়ার বা পশু হনন করতে আসে না, বরং কোরবানির মাধ্যমে পশুপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার যে একটি উত্তম ব্যবস্থা তা স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা প্রতিবছর ফিরে আসে।

আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে করোনা ভাইরাসময় এই সময়ে কোরবানির সঠিক দীক্ষা নিয়ে শান্তিপূর্ণ, প্রেম ও ভালোবাসা বিজড়িত এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলি।

মোঃ শামছুল আলমঃ লেখক ও কলামিস্ট।

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: