নজরুল মৃধাঃ
আজ পহেলা অগ্রহায়ণ। ঋতু চক্রের পথ পরিক্রমায় হেমন্ত কাল। এই দিনে নবান্নের ঘ্রাণে মেতে উঠে কৃষকের অঙ্গিনা। এ অঞ্চলে কৃষকদের ঘরে ঘরে আমন ধান কাটা মাড়াই শুরু হেেয়ছে বেশ কয়েদিন আগেই। বাজারে ধানের দাম ভাল এবং বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই ভালভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারায় কৃষকরা বেজায় খুশি। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ের যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হত নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কল্যানি ইউনিয়নের কৃষক নজরুল ইসলাম বুলবুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন, ১০ বছর আগেও ধুমধাম করে পহেলা অগ্রহায়ণে তিনি নবান্ন পালন করতেন। নবান্নে তিনি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। তিনি জানান, বাড়ির কর্তা হিসেবে তার বাবা ২ দিন আগে সকালবেলা গোসল সেরে পবিত্র হয়ে বাম হাত দিয়ে এক মুঠি ধান কর্তন করে নবান্নের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করতেন। বেশ কবছর থেকে তার বাড়িতে এসব অনুষ্ঠান অনুপস্থিত।
রংপুর নগরীর ৭ নং ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তারের পুত্র চাকরিজীবী তরুণ আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, আমি ছোটবেলায় দেখেছি, দাদা-দাদি, নানা-নানি আত্মীয়-স্বজন সকলে মিলে নবান্ন উৎসব পালন করত। ধান ঘরে তোলার দিন মসজিদের ইমামকে ডেকে দোয়া পড়িয়ে নবান্ন উৎসব শুরু করা হত। সবাই মিলে এক সাথে দুপুরের খাবার খেতাম। এখন আর এইসব নেই। মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়া, আগের মত আত্মীয়ের বন্ধন অটুট না থাকা, সর্বোপরি নবান্ন উৎসব করতে গেলে বাড়তি খরচ লাগে। এসব কারণে ধীরে ধীরে নবান্ন উৎসব উঠে যাচ্ছে গ্রামীণ সমাজ থেকে।
এদিকে প্রকৃতিতে অগ্রহায়ণ এলেই কৃষককেরা দিগন্ত জুড়ে ধানকাটা মাড়াই উৎসবে মেতে উঠেন। ব্যস্ত সময় কাটান কৃষক-কৃষাণীরা। ধান তোলার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে। কৃষকের বাড়ির আঙ্গিনা ভরে উঠে সোনালী ধানে। নতুন চালের ভাতে ভিন্ন এক আমেজ এনে দেয় কৃষক পরিবারে। অনেক পরিবারে তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর, পায়েসসহ নানা উপাদেয় খাদ্য।
কিন্তু অদৃশ্য এক সুতার টানে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের মাঝ থেকে পহেলা অগ্রহায়ণের এসব উৎসব। কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন, বাড়তি ঝামেলা ও খরচের ভয়ে কৃষকরা অনুষ্ঠানে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবকেই নবান্ন উৎসব বলা হলেও রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বাস্তব জীবন থেকে এই উৎসবটি অচেনা এক দূরে চলে যেতে বসেছে।
ইতিহাস লেখক জুবায়ের আলী জুয়েল বলেন, গ্রামে গঞ্জে আবহমানকাল ধরে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়ে এলেও বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই উৎসবে ভাটা পড়েছে। তবে কৃষক ছাড়াও বিভিন্ন শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠন নবান্ন উৎসব নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালন করে থাকেন। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব উদযাপন করলেও এর মূল উৎস গ্রাম থেকে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এটিকে ধরে রাখতে হলে গ্রামীণ জীবনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় প্রায় প্রায় ৬ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আমন আবাদ হয়েছে।
সৌজন্যে. বিডি প্রতিদিন/এএ