নেছার আহমদ জামাল
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ শব্দটা মনে আসতেই মনের মধ্যে একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। ছেলেবেলার ঈদগুলো ছিল খুবই সুখময় স্মৃতির দিন। ঈদ যত ঘনিয়ে আসে আনন্দের মাত্রা তত বাড়তে থাকে। ঈদ, নতুন জামা, পিঠা-পায়েস, ঈদের দিনের সালামী, কোলাহল ঈদের ছুটিতে আত্মিয়ের বাড়িতে বেড়াত যাওয়া সব মিলিয়ে ঈদের আগের কয়েকটি দিন কাটে স্বপ্নের ঘোরে। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা ঈদ কবে আসবে, ঈদ কবে আসবে।
ছোটবেলা (নব্বই দশকে) আমাদের ঈদের আনন্দের অনেকগুলো অনুসঙ্গের মধ্যে অন্যতম ছিল ঈদের আগের রাতে সবার আগে সর্বপ্রথম গোসল করার প্রতিযোগিতা। আমাদের বাড়ীটাকে বলা হয় কলের বাড়ী। যখন বৃহত্তর সালুটিকর অঞ্চলে ধান ভাঙ্গানোর কোন মেশিন ছিল না তখন আমাদের বাড়ীতে ধান ভাঙ্গানোর একটা মেশিন ছিল বলে এই বাড়ীকে ‘কলো বাড়ী’ বলে ডাকা হত। লোক সংখ্যার বিচারে আমাদের গ্রামে দু’তিনটি বাড়ী বড় ছিল তাদের অন্যতম আমাদের কলের বাড়ী। আর তখনও এ বাড়ীতে শিশু কিশোরের সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশজনের মতো। কলের বাড়ীর ছেলে-মেয়েদের একসাথে স্কুলে যাওয়া, মাঠে খেলতে যাওয়া এমনকি একসাথে মারামারি করাও অঘোষিত নিয়ম ছিল। সেই অঘোষিত নিয়মানুসারে সবাই একসাথে ঈদের গোসলও করত। সবার ভিতরেই একটি চাপা উত্তেজনা বিরাজ করত ভোর রাতে ঘুম থেকে ওঠে কে কার আগে গোসল করবে।
আমার আম্মার একটা গুণ হল তিনি সারা বছরই সবার আগে ফজরের নামাজের জন্য উঠেন। তারপর সবার দরজায় দরজায় গিয়ে ডাকেন। এজন্য রমজান শেষে ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে বাড়ীর ছোটরা বায়না ধরত আম্মার কাছে ঘুমাবে। উদ্দেশ্য একটাই, সবার আগে ঘুম থেকে ওঠা। আম্মাকে কেউ বলত চাচী আমাকে আগে ডাক দিবেন। কেউ বলত বিবি (দাদি) আমাকে আগে ডাকবেন। তারপর আমাদের ঘরে খাটের উপর আট-দশজন, সিন্দুকের উপর ছয়-সাতজন আর বাকীরা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাতেন। এ দলে আমরা যারা থাকতাম তাদের মধ্যে ফখর, বুরহান, ফয়ছল, মিছবা, সাজিম, নাজিম, জসিম, বদরুল, সাহেদা, রুনা, খালেদা, জয়ধন, আলী হুসেন, জয়নাল, নাছির, তারেকসহ অনেকেই ছিল। আম্মা ভোর রাতে সবাইকে একসাথে ডাকতেন। তারপর একে অপরকে ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙ্গাত। কেউ ঘুমের ঘোরে হা হু করে, কেউ এক লাফে ওঠে। তারপর যারা উঠল তারা অন্ধকারের মধ্যে (তখনও আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না) উঠে একদৌড়ে পুকুরে গিয়ে ডুব দিত। সবচেয়ে মজা হত শীতের সময়। অনেকে ভোরে উঠে গোসলে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জনের জন্য লেপ-কাতা ফেলে জামা কাপড় খুলে পুকুরে ঝাপ দিতো ঠিকই, কিন্তু পরে হাড়কাঁপানো তীব্র শীতে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ঠাট-ঠাটা-ঠাট করে কাঁপত। সেই কাঁপুনি নিয়ে সেকি হাসাহাসি! অতঃপর খড়ে আগুন দিয়ে সবাই শীত নিবারণ করত।
ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে মা-চাচীদেরও ব্যস্ততা বেড়ে যেত। সারা রাত পিঠাপুলি তৈরিতে সবাই মহা ব্যস্ত। একেক ঘরে একেক ধরণের পিঠা তৈরী করে প্রথমে বাড়ীর সবচেয়ে প্রবীন মুরব্বি যিনি তাকে দেয়া হত। তারপর প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ঘরে পিঠা, সন্দেশ আদান প্রদান করত। পুরুষদের মধ্যে অনেকই ছিলেন যারা ঈদ উপলক্ষে অনেক দিন পর বাড়ীতে এসেছেন তারা কে কোন্ ধরণের পিঠা খেতে পছন্দ করেন সেটা তৈরি নিয়ে মহিলারা ব্যস্ত। সন্ধা রাতেই গরম গরম পিঠা আর সন্দেশ একবার খাওয়া হয়ে যেত। এর মধ্যে গরম পিঠা খেতে কারোবা হয়ত মুখ পুড়ে যাচ্ছে, কেউ বলছে আমাকে আরেকটা দাও, আমাকে আরেকটা দাও।
ভোর বেলা গোসলের পর আসে নতুন জামা পরিধান পর্ব। একে একে সবাই নতুন জামা পরে শুরু করে দিল কার জামা সবচেয়ে সুন্দর সেই আলোচনা-সমালোচনা। ছোটদের কারো জামা সুন্দর নয় বলে অপেক্ষাকৃত বড়রা ক্ষেপাত, এতে হয়ত কেউ কেউ কেঁদে কেঁদে তার মায়ের কাছে নালিশ করত। মা হয়ত বুঝিয়ে বলতেন তোমার জামাটা সবচেয়ে সুন্দর; তবেই কান্না থামতো। তারপর পিঠা সন্দেশ, নুনের সন্দেশ ইত্যাদি বাহারি মুখরোচক খাবার খেয়ে ঘরে ঘরে দল বেধে গিয়ে বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করা। ঈদের সালামী হিসেবে বড়দের কাছ থেকে কড়কড়ে নতুন হরিণ মার্কা এক টাকার বা দোয়েল মার্কা দুই টাকার নোট পেতাম। তারপর সবাই একসাথে দল বেধে মসজিদে (গ্রামে ঈদগাহ না থাকায়) ঈদের নামাজে যেতাম। ঈদের জামাতের পর মসজিদের ভিতর বিচার হত কারা রোযা ছেড়েছেন তাদের নিয়ে। তারপর তাদেরকে পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে পানিতে ডুব অথবা কানমলা খেতে হত। এ নিয়ে অনেক সময় গণ্ডগোলও বেধে যেত। ঈদের নামাজের পর বড়দের মত ছোটরাও কোলাকোলি করতাম, বড়দের পা ছুঁয়ে আবার সালাম করতাম। গ্রামে গঞ্জে এখনো এই রেওয়াজ আছে। ঈদের দিন বিকেলে গ্রামের মাঠে প্রীতি ফুটবল বা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হত। সবচেয়ে মজা হত বর্ষাকালে ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলে। তখন খেলা ফেলে বৃষ্টিতে ভিজে সবাই কাদামাটিতে মিশে একাকার।
ঈদে ঈদকার্ড ছিলো ঈদের আরেক বড় অনুষঙ্গ। অপেক্ষাকৃত বড়দের মধ্যে ঈদকার্ড আদান প্রদান হত। ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ঈদ কার্ড বহুল প্রচলিত একটি মাধ্যম ছিল। বাজারে বাহারি রঙের বাহারি ডিজাইনের ঈদকার্ড পাওয়া যেতো। সেগুলো কিনে এনে মনের মাধুরি মিশিয়ে দু চারটা লাইন লিখে প্রিয়জনকে দেয়া হতো। রং বেরংয়ের ডিজাইনের কার্ড ছিল প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানানোর উপায়। বড় সাইজের কার্ডকে মনে করা হতো বেশি ভালবাসা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। অনেক কার্ডে আবার মিউজিকও বাজতো। ঈদ কার্ড কিনে এনে কবিতার দুটি লাইন কিংবা প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকুতি লিখে দূরের স্বজনকে পাঠাতে পোস্ট অফিসে নিয়ে যাওয়া। প্রিয়জন এই কার্ড পেয়ে যারপর নাই খুশি হয়ে খুব যত্ন করে রেখে দিতেন নিজের কাছে। অনেক দিন পর হয়ত কোন কারণে কার্ডটি চোখের সামনে পড়েছে তখন স্মৃতি রোমন্থন করতেন ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কার্ডের পরতে পরতে যেন রয়ে গেছে প্রিয়জনের ছোঁয়া। কেউ কেউ আর্ট কার্ডে রং পেন্সিল দিয়ে মনের আবেগ উজাড় করে চিত্রকল্প এঁকে কার্ড উপহার দিতেন। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু মকবুল ভাই নিজে আর্ট করে আমাকে অনেক কার্ড পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।
আজকাল ভারচুয়াল জগতের কল্যাণে এসব আর নেই। রাত জেগে তুলির আছড়ে মনের কথা না লিখে এসএমএস, এমএমএস, ফেইসবুক, টুইটার, হোয়াটসআপ, ভাইবারে মুহুর্তেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্বজনদের কাছে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ কার্ডের প্রচলন এখন চলে গেছে রাজনীতিবিদ আর কর্পোরেট দুনিয়ার স্বার্থভোগীদের দখলে। তারা শুধু তাদেও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের কাছে ঈদ কার্ড বিতরণ করে। চার কালারের ঝকঝকে ছাপা আর কম্পিউটার গ্রাফিক্যাল চমৎকার ডিজাইনে সেই ভাঙা ভাঙা হাতের লেখার সেই মায়া অনুভব হয় না। মনের আবেগে নিছক ভালবাসায় এখন ঈদ কার্ড দেয়া হয় খুব কম। তবু ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে, আমরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করি সবার সাথে। কামনা করি বিশ্ব মুসলিমের এই আনন্দের সাথে ফিলিস্তিনের শিশুরাও যেন ফিরে পায় ঈদের আনন্দ।
নেছার আহমদ জামাল: লেখক, প্রকাশক।