
মোহাম্মদ আব্দুল হক
পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই বড়ো বড়ো অক্ষরে শিরোনাম পড়তে হয় সরকারি অমুক অফিসের গাড়ি চালক না-হয় কেরানি কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে শুরু করে বড়ো কর্মকর্তা শত শত কোটি টাকার মালিক, বহুসংখ্যক ফ্ল্যাট, একাধিক বহুতল ভবন এবং বিদেশে বাড়ি ও ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এমন খবর-ই বিগত বছরগুলোতে পত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রতিদিন প্রচারিত হয়ে আসছে। পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে এ নিয়ে সতর্কতা মূলক লেখা ছাপা হয়েছে। দেশের সীমাহীন দূরন্ত গতির দুর্নীতির ট্রেনকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে দেশের বিশিষ্টজনের দিকনির্দেশনা মূলক ও গবেষণা ধর্মী লেখা ছাপানো হচ্ছে পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয় কলামে। কিন্তু দুর্নীতি রুখে দিতে সরকারের যেসব অফিসে কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় সেই অফিসের ভিতরেই যদি দুর্নীতির বৃক্ষের চাষ হয়ে যায় তাহলে সরকার দুর্নীতি নির্মূল করবে কিভাবে? যারা সুনীতি রক্ষা করে ন্যায় পথে থেকে চাকরি করার শপথ নিয়ে চাকরিতে যোগদান করে তারা-ই যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন আমার মতো সাধারণ মানুষকে গাড়িতে, বাজারে, ফুটপাতে, কীনব্রীজে, হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গনে, মহল্লার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে হয় – ‘এদেশে আর মানুষের শান্তি আসবে না, অভিশপ্ত রক্ষকরাই এখানে ভক্ষক’। সেদিন এক তরুণ রিকশা চালক বললো, ‘ স্যার আমি নতুন ভোটার হইছি ; বেশি লেখাপড়া করতে পারি নাই, কলেজে ভর্তি হইছিলাম। আমার আব্বা ধান চুরি করে ধরা খাইছিলো। তারপর আম্মায় আমারে নিয়া শহরে চলে আসে। আম্মায় বলে, আমি আর চোরের সংসারে থাকবো না। তারপর আম্মায় বাসায় কাজ কইরা আমারে পড়াইছেন। আম্মায় আশা করছিলেন আমি বড়ো হইয়া সরকারি চাকরি করবো। কিন্তু স্যার টেলিভিশনে দেখি কয়দিন বাদে বাদে সরকারি কর্মচারী টাকা চুুরি করে ধরা পড়ে। লেখা পড়া কইরা যারা চুরি করে তাদেরকে কি তাদের বউয়েরা আমার আম্মার মতো চোরের সাথে সংসার করবো না বলে ছেড়ে চলে যায়, জানি না।’ প্রিয় পাঠক আমিও জানি না এদেশে কতোজন স্ত্রী ‘চোরের সাথে সংসার করবো না’ বলে স্বামীকে সুপথে ফিরতে হুঁশিয়ার করে। তবে হ্যাঁ, এভাবেই সাধারণ মানুষের মনে চোরদের সম্পর্কে ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্ম নেয়।
আমাদের এই দেশটি অল্প আয়তনের অধিক জনসংখ্যার এক কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী প্রায় দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে প্রায় ১৬ কোটি ৫৭ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীর দেশগুলোর তুলনায় সর্বোচ্চ, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১১১৬ জন। এখানে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি দুষ্ট লোকের দুর্নীতির থাবায় সাধারণ মানুষ বারবার মরতে মরতে বাঁচে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট সফলতা লক্ষ্য করা গেলেও সরকারি অফিসের দুর্নীতি যেন সরকার কোনো ভাবেই প্রতিরোধ করতে পারছেন না। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে শুরু হওয়া করোনা মহামারির থাবা যখন বাংলাদেশে এসে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তখনও অসত ও দুষ্টদের লুটপাট থেমে থাকেনি। এর-ই মাঝে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি দৃঢ় উচ্চারণ আমাদেরকে আশান্বিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার একটি দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার শপথ নিয়ে সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রতি নিজস্ব উদ্যোগেই শুদ্ধাচার ও এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সেদিন অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স এগ্রিমেন্ট ( এ পি এ) – ২০২০ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে আরো বলেন, ‘ আমরা দেশে একটি ঘুষ ও দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই এবং আপনাদেরকেই এই শুদ্ধাচারের পরিকল্পনা করতে হবে এবং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে।’ দেশের করোনাকালীন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী গণ ভবন থেকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত উক্ত অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুব-ই আশাবাদী হয়েছি। পরক্ষণেই কেন যেন মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন বারবার জেগে উঠেছে – যেখানে দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মচারীরা আকন্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে আছে, সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তার প্রত্যয় বাস্তবায়ন করতে পারবেন ?
আমাদের এই দেশের উপর দিয়ে প্রতি বছর একাধিক বার বয়ে যায় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, যা বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলের কোটি মানুষের জীবনকে পর্যুদস্ত করে দেয়, প্রায় প্রতি বছর বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হয় মারাত্মক ভাবে। এরপরও আমরা দেখতে পাই বিগত বছরগুলোতে এদেশের কোনো মানুষ অনাহারে মারা যায়নি। আমরা দেখেছি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে গৃহহারা মানুষের পাশে সরকারি নির্দেশে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে গেছে। ওইসব ত্রাণ নিয়ে কোথাও কোথাও কিছু কিছু দুর্নীতি হলেও আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক নেতৃত্বে দুর্যোগ মোকাবেলা হয়েছে। বর্তমানে চলমান মহামারি কোভিড-১৯ এর কারণে যেখানে বিশ্বের ধনী এবং শিক্ষা দীক্ষায় ও জ্ঞান – বিজ্ঞানে অধিক সমৃদ্ধ দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল সেখানে আমাদের মতো শিক্ষায়, জ্ঞান – বিজ্ঞানে, গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চায়, স্বাস্থ্য সচেতনতায় পিছিয়ে পড়া এবং দুর্বল অর্থনীতির একটি দেশ এখনো প্রায় স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে টিকে আছে। এতোসব বিষয় বিবেচনা করে আমি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার প্রত্যয়’ এর ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও আশার আলোক দেখতে পাই। এখানে আমি বিশ্বাস করি, অল্প কিছু দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও অসত কর্মচারীর কারণে আমাদের এই দেশটি একেবারে ব্যর্থ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এখনো আমাদের প্রশাসনের অধিক সংখ্যক মানুষ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, সৎ এবং তাঁদের মাঝে আছে সঠিক দেশপ্রেম।
দীর্ঘ আলোচনা করবো না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘ জনগণের পাশে থাকা প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়িত্ব। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছি বলে তাদের পাশে থাকা আমাদেরও দায়িত্ব। আমরা জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আর যারা সরকারি চাকরি করেন তারা-ও জনগণের সেবা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ প্রধানমন্ত্রীর এই কথায় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি নিজেদেরকে খুঁজে পান, তাঁদের মর্যাদা বুঝতে পারেন এবং তাঁদের মনন জাগ্রত হয়ে ওঠে, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার প্রত্যয়ের ঘোষণার ইতিবাচক পরিণতি এই জাতির সামনে আগামী দিনে আসছে, এমন প্রত্যাশা আমরা করতে-ই পারি।।
# লেখক _ কলামিস্ট কবি ও প্রাবন্ধিক