রবিবার, ২৮ মে ২০২৩ খ্রীষ্টাব্দ | ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আশার সেই চিঠি খুঁজে পাইনি 




মোহাম্মদ আব্দুল হক

রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতার উত্থান সময়ের প্রকাশিত চরিত্র  এবং সময়ে বেড়ে উঠা জন আকাঙ্খার চরিত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে ব্যাপারটাকে এভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে, ‘ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।’ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রীষ্টিয় সালের পরপর আওয়ামী লীগ তাড়াহুড়ো করে একদলীয় শাসনের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করে এবং তারপর দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা পরবর্তীতে ঘুরে দাঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী দল এখন অনেক বেশি সংগঠিত। দলটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার চরিত্র ধরে রাখতে যথেষ্ট সচেতন। বলতেই হবে দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীর দলকে প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দেয়নি। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের গঠনের শুরু থেকেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং কতোগুলো ছক এঁকে জনসমর্থন নিয়ে প্রকাশ হওয়া দরকার। আমি মনে করি যেকোনো সংগঠনকে তার চরিত্র ঠিক করে এগুনো উচিত। সেটি সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন কিংবা রাজনৈতিক সংগঠন হতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে এককভাবে কঠিন হলেও কখনও কখনও কোনো ব্যক্তি যখন তার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়, তখন তার পক্ষেও এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক হুমায়ুন আহমেদ প্রকাশের শুরু থেকেই তা  পেরেছেন। তিনি তাঁর প্রায় সকল প্রকাশেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের শত্রুকে দৃঢ়তার সঙ্গে দূরে ঠেলে রেখেছেন এবং আমরা জানি তিনি তাঁর নাটকে পাখির কন্ঠে ‘তুই রাজাকার’ বলে গালি দিয়ে সারা বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারীকে ও যুদ্ধাপরাধীকে ঘৃণা প্রকাশ করে গেছেন। আরেকজন বিশিষ্ট লেখক শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তিনিও তাঁর সকল প্রকাশে এখনও তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে এগুচ্ছেন। ২০০১ খ্রিষ্টিয় সালের পরে কোনো এক সময় যখন দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধীদের দল নিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে, তখন আমি হতবাক হয়ে যাই। কারণ, আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে আমি হ্যান্ডশেক করেছিলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ছোঁয়া পেয়েছিলাম। সেই সময় কোনো একটি দৈনিক পত্রিকা প্রখ্যাত লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি লেখা ছেপেছিলো। সেদিনের লেখায় এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীর গাড়িতে এদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ছুটে চলা নিয়ে খুব আবেগ মাখানো ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছিলো, যা আমাকে ছুঁয়ে যায়। ওই লেখাটি পড়ে আমি আমার সুনামগঞ্জের বিল পাড়ের বাসায় বসে একটি চিঠি প্রিয় লেখক ও স্যারকে লিখেছিলাম। আমি যা লিখেছিলাম তার মূল কথা ছিলো, স্যার পত্রিকায় আপনার লেখা পড়েছি। কিন্তু এতো লিখে কি হলো, স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে শেষ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় পতাকা উঠেই গেল।
তখনও এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিলো না বা আমাদের মনের কথা লিখে প্রকাশ করার মতো আমাদের ফেসবুকের দেখা মিলেনি।মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার তখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। চিঠিটি আমি সুনামগঞ্জ ডাক ঘরে গিয়ে খামে ভরে দুই টাকার ডাক টিকিট লাগিয়ে ডাক বাক্সে ফেলে দিয়েছিলাম। খুব মনে পড়ে, ডাক টিকেটে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল পাখির ছবি ছিলো। আমি বর্তমান সময়ের অনেক ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা ডাক টিকেটের ব্যাপারে কোনো ধারণা করতে পারে না। সে যাই হোক, চিঠি পোস্ট করে দিয়েছি, হলুদ খামের একপাশে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের নাম লিখে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় লিখে দিয়েছি। আর অন্যপাশে আমার নাম ও বাসার ঠিকানা লিখে দিয়েছি। স্যার চিঠি পাবেন কি-না জানি না। আবার পেলেও স্যার এতো ব্যস্ততার মধ্যে আমার চিঠি পড়ে জবাব লিখে পাঠাবেন এমনটি আমি ভাবতে পারিনি।
আমার চিঠি পাঠানোর এক সপ্তাহের মধ্যে সুনামগঞ্জ ডাক ঘরের ডাক পিয়ন আমাকে অবাক করে দিয়ে বাসায় এসে আমার হাতে একটি হলুদ খাম ধরিয়ে দিলেন। আমি চিঠির খাম হাতে নিয়ে পড়ি, খামের উপর লেখা আছে, প্রেরক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমি কিছু সময় খুশিতে খাম হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে খাম খুলে স্যারের লেখা চিঠি পড়ি। স্যার অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ ছিলো, আপনার মতো মানুষেরা সারা দেশে আছেন বলেই লিখি এবং লিখতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস আছে, বিজয়ের ইতিহাস আছে। কাজেই আমাদের হতাশ হবার কিছু নেই। একদিন সবকিছুর বিচার হবে।
মাঝে মাঝে দেশের কথা একটু গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়ি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মুক্তিযোদ্ধা, ত্রিশ লক্ষ শহীদের কথা এবং আমদের বর্তমান সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে চিন্তা করি। সারাদেশ ব্যাপী সকল সরকারের সময়ে অবকাঠামো উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে। তবুও আমাদের শান্তি হলো না। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় অর্ধ শত বছরেও আমাদের দেশের মানুষের মাঝে সুখের সন্ধান পাওয়া যায় না। এমন অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। লক্ষ্য স্থির রাখতে না পারা সংগঠনের ভুলের কারণেই দিনে দিনে আমরা আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যেখানে ধর্ষণ, ঘুষ, লুটপাট, অন্যায়, গুম, খুন , চুরি সংবাদ মাধ্যমে দৃশ্যমান। সবকিছুই চলে রাজনীতির পরিকল্পনা মতে। আমি রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বুঝি না। তাই কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাই না। তবে প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতার মাস আসে, বিজয়ের মাস আসে। তখন কিছু কিছু বিষয় চোখের সামনে আশার প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠে।
আজ পুরনো কাগজপত্র রাখার ফাইল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। নাই কোথাও নাই। আমার লেখা চিঠির জবাবে আমাকে লেখা মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সেই চিঠি খুঁজে পাইনি। তবে হ্যাঁ, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা যারা করেছে তাদের বিচার হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে। হ্যাঁ, যারা দেশের মানুষের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতিতে কৌশলে ভুল করে দেশবাসীকে আঘাত করেছে, অপমানিত করেছে তারাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
এজন্যেই মনে করি, প্রকাশিত পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের চরিত্র ঠিক করে এগুনো দরকার। ব্যক্তি পর্যায়ে দৃঢ়তা অর্জন করতে পারলে আরো ভালো হয়। সফলতা ধীরে ধীরে আসুক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমার সেই চিঠি খুঁজে না পেলেও আমি আশাবাদী এবং শুদ্ধতার চর্চায় নিয়োজিত তরুণ তরুণী ও সৃজনশীল মানুষের কাছে বলি জ্বালিয়ে যাও আলো। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস আছে এবং আমাদের বিজয় দিবস আছে, কাজেই আমাদের পুরোপুরি অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। গৌরবের ইতিহাসের যেটুকু আলো আমাদের আছে – চলো আলো জ্বেলে যাই।।
মোহাম্মদ আব্দুল হক: কলামিস্ট ও সাহিত্যিক

সম্পাদক: শাহ সুহেল আহমদ
প্যারিস ফ্রান্স থেকে প্রচারিত

সার্চ/খুঁজুন: